গোটা পৃথিবী এখন বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের শিকার। মানুষের মন-মগজ নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে তুমুল লড়াই। এই লড়াইয়ে তাৎক্ষণিক ফলাফলের দেখা পাওয়া কঠিন। কে হারবে আর কে জিতবে, তা অনুমান করা দুঃসাধ্য। তাই এর ব্যাপ্তি সুদূরপ্রসারী। এখন বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো ইস্যু পেলে পরিণত বয়সীরা তো অবশ্যই; এমনকি যাদের সবে আক্কেল দাঁত গজিয়েছে, বুদ্ধিতে এখনো পরিপুষ্ট হয়নি, তারাও মুখ ব্যাদান করে উঠছে বুঝে না বুঝে।
এসব বিবেচনায় মনে হচ্ছে, এখন বুদ্ধিচর্চার বিষয়টায় কেউ আর জ্ঞান ও বয়সের উপযোগিতাকে মানছে না। আমলে নিচ্ছে না বুঝেশুনে কথা বলার ব্যাপারটাকে। একটা বিষয়ে ইচ্ছে হয়েছে বা সুযোগ পেয়েছে কথা বলার, বলে ফেলছে পট করে; কীসের এত চিন্তাভাবনা! সাধারণ কথাটি বলার আগে যে দম নিতে হয়, শ্রোতা বা প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হয়, এটাও ভুলে যাচ্ছে কেউ কেউ। এতে করে আমাদের সমাজে আঁতেলদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলছে।
একটা ব্যাপার খেয়াল করছি, বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তিতে আমাদের তারুণ্য—বিশেষ করে মাদরাসাপড়ুয়াদের মন-মানসিকতায় একটা রকমফের পরিবর্তন চলে এসেছে। এতে করে তারা একইসঙ্গে হয়ে উঠছে ভাবলেশহীন, বেপরোয়া ও মারদাঙ্গা। আমার বোধ ও পর্যবেক্ষণে এটাকে এক ধরনের ব্যাধি বলে মনে হচ্ছে। এই ব্যাধির নাম ইন্টেলেকচুয়াল ভাইরাস বা বুদ্ধিবৃত্তিক মহামারি। এর প্রভাব পড়েছে তাদের প্রতিদিনকার জীবনে।
মাদরাসাপড়ুয়াদের বিশেষভাবে ট্যাগ করার কারণ, অনলাইনে এসে তাদের একদল এই কাজটি বেশি করে থাকে। আক্কেল দাঁত গজানোর সাথে সাথে বুদ্ধির গন্দমে কামড় বসাতে মুখ হাঁ করে ওঠে। এতে কে কোন বয়সী, কার স্তর কোনটি—এই বিবেচনাবোধ অনেকের থাকে না। এখনো মুতাওয়াসসিতার স্তর পার হয়নি, এমন ছেলেটি বড় ভাই ও উস্তাযতুল্য এবং বয়সে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের জ্ঞান দিতে আরম্ভ করে। তাদের কোনো ভুল-বিচ্যুতির আলোচনা উঠলে শুরু করে সাইবার বুলিং। এখানে কোনো বিষয় খতিয়ে দেখা তো দূরের কথা, মূল বিষয়েও আধা অক্ষর জ্ঞান রাখে না বহু আবেগী কিশোর-তরুণ।
এরকম বিষয়ে বিজ্ঞজনরা নানারকম সমালোচনা করেন। এই সমালোচনার দাঁড়িপাল্লার মাপটাও জানে না তাদের অনেকে। এখানে কোনো একটি কথা জজবায় আগুন ধরিয়ে দিলে সমবয়সী ও সমচিন্তকরা আসে ঘিয়ের মটকা নিয়ে। তারপর জোটবদ্ধ হয়ে শুরু করে জ্ঞান খয়রাত আর সাইবার বুলিংয়ের তুমুল আগ্রাসন। এটা খুবই নীচু মানসিকতা ও বুদ্ধিহীনতার কাজ; মারাত্মক অপরাধও!
ফেসবুক কেন্দ্রিক ইস্যু যুদ্ধকে আমি সবসময় এড়িয়ে চলি। পুরো ব্যাপারটাকে মনে হয় বেলুনের হাওয়া। যার বুকে যত দম, মুখভরে ফুঁকতে থাকে। এই বেলুন যে ফুটো, এটাও অনেকের মাথায় থাকে না। আমার কাছে ব্যাপারটা যেমন বিরক্তিকর, তেমনই ন্যক্কারজনক লাগে। তাই এসব বিষয়ে চুপচাপ থাকি। কিন্তু নিজের জ্ঞাতি ভাইদের যখন দেখি এগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আগুনে পাওয়া পোকার মতো, তখন বেদনায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না!
কিশোর-তরুণ ভাইটি আমার, হৃদয়ে তারুণ্যের বারুদ পোষা মানে যখন-তখন ফুঁসে ওঠা নয়। এই বারুদ জমিয়ে রাখতে হবে উপযুক্ত ক্ষেত্র ও পরিস্থিতির জন্য। গভীর জ্ঞান, প্রখর বুদ্ধি আর সঠিক বয়স তোমাকে পৌঁছে দেবে সেখানে—যেখানে এই বারুদ ফাটালে হওয়া যাবে সেরা যোদ্ধা। তাই আমার পরামর্শ—নিজেকে ধরে রাখতে শেখো, মুখে লাগাম দাও আর মনকে নিয়ন্ত্রণ করো। কেননা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে আগামীর পৃথিবী!