বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাং দেখছিলাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্বচ্ছ পানির ঢেউখেলানো এই নাব্য গাং; নাম তার ধনু—ময়মনসিংহ গীতিকায় যার বর্ণনা আছে। দিনমান তাতে চলাচল করে ডিঙি নাও, ট্রলার, লঞ্চ-কার্গো আর স্টিল বডির নৌকা। বাড়ির পেছনে দাঁড়ালে এ সব দেখা যায়। এমনকি ঘরে বসে শোনা যায় ট্রলারের ভটভট শব্দ আর লঞ্চ-কার্গোর দূরবর্তী সংকেত।
এই মুহূর্তে গাং দিয়ে একটা বিশাল কার্গো চলে গেল—বিকট সাইরেন হেঁকে। ওটা দেখার জন্য ছুটে এলাম এখানে। শিশুসুলভ কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। মুগ্ধ হলাম দারুণ। কার্গোটা দেখতে অবিকল আমার খেলনা-লঞ্চটার মতো। নয়াগাঁওয়ের বান্নি থেকে আব্বা আমাকে যেটা কিনে দিয়েছিলেন—প্লাস্টিকের চমৎকার লঞ্চ। দেখতে যেমন সুন্দর, এটা নিয়ে খেলতেও তেমন মজা। কিন্তু অবাক লাগল, আমার সেই খেলনা-লঞ্চটার মতো এত বড় একটা কার্গো গাং দিয়ে কীভাবে চলছে—পানির ওপর দৌড়ে দৌড়ে; এর মধ্যে আবার মানুষও আছে!
এমন ভাবনায় বিভোর ছিলাম। হঠাৎ করে আমার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড ভয় পেলাম। এক দৌড়ে চলে গেলাম মাঝঘরে। আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম। বুকটা তখনো ধুকপুক করছে। আমার কাণ্ড দেখে আম্মা ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলেন, ‘এই অনিক, কিতা অইছে তর? এ্যামনে কাঁপতাছস ক্যারে?’
আমি ভয়কাতর গলায় বললাম, ‘আম্মা, বাড়ি পিছের মাডি কাঁপতাছে!’
আম্মা তখনই আমাকে কোলে নিয়ে সেখানে গেলেন। ঠিক সেসময় আমার চোখের সামনে রান্নাঘর-লাগোয়া পাড়ের মস্ত মাটির ডেলাটা ভেঙে পড়ল নিচে—গাঙের পানিতে। ধপাস শব্দ হলো। আমি আবারও প্রচণ্ড ভয়ে আম্মার গলা জড়িয়ে ধরলাম। আম্মা স্মিতমুখে বললেন, ‘বেক্কল, ডরাস ক্যারে? দইর পড়সে!’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম—একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ওটা ভেঙে পড়ে গেছে গাঙের পানিতে। এখন এই ভাঙন আর আমাদের রান্নাঘরের মাঝে একহাত ব্যবধান। যেকোনো মুহূর্তে রান্নাঘরটাও ভেঙে পড়তে পারে। এরপর বড়ঘরটা। তারপরই সব শেষ। নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের চৌদ্দপুরুষের ভিটেবাড়ি।
‘মা-ফুত এহানে খাড়ইয়া কিতা করো?’
আমি আর আম্মা রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় দাদু এসে বললেন এ কথা। দাদুকে দেখে আম্মা বললেন, ‘মায়া, অনিক দইর ভাঙা দেইখ্যা ডরাইছে।’
দাদু কিছুটা উষ্মামাখা গলায় বললেন, ‘তুমি এরে এহানে লইয়া আইছ ক্যারে? এমনেই যে বালা-মসিবত আইতাছে…’ বলে দাদু রান্নাঘরের দিকে তাকালেন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আল্লা জানে, কোম্বালা রান্দাঘরটা পইড়ে বড়ঘরটাও যায় গা গাঙের তলাত!’
সেদিন রাতে আমরা আগলাঘরে ঘুমিয়েছিলাম। সকালবেলা উঠে দেখি ভয়ানক কাণ্ড। আমাদের রান্নাঘরটা পড়ে বড়ঘরেরও অনেকটা ভিটে পড়ে গেছে নদীর ভাঙনে। পশ্চিম দিকের টিনের বেড়াটা ঝুলে আছে। এদিকের বেশ কটা খালি মটকা আর হাঁড়িকুড়ি পড়ে গেছে নিচে—গাঙের পানিতে। দেখি দাদা-দাদু, আব্বা ও চাচারা সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। ভাঙাঘরের ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্র কুড়িয়ে একত্র করছেন। কারও মুখেই রা সরছে না। সবার চোখেমুখে গভীর বেদনার ছাপ স্পষ্ট। এই বেদনা চরম দুঃখবোধের। চৌদ্দপুরুষের ভিটেবাড়ি হারানোর সীমাহীন মনোবেদনা।
একটু পরে দেখি বাড়ির সামনে একটা বড় নৌকা এসে ভিড়ল। আব্বা ও চাচারা মিলে গোলার ধান বস্তায় ভরে সেখানে ফেলতে লাগলেন। দাদা-দাদু ও বড় ফুফু মিলে ঘরের জিনিসপত্র, হাড়ি-পাতিল সব আরেকটা ডিঙি নাওয়ে তুলছেন। তখন দাদা আম্মাকে ডেকে বললেন, ‘অ অনিকের মা, এরারে লইয়া নাওঅ উড গা!’
আম্মা আমাকে নিয়ে নৌকায় উঠলেন, সঙ্গে ছোট বোন আনিকা। বড় ফুফুর ছেলেমেয়ে—সরমিন আপা, বাবন আপা, বাবলু ও তৃপ্তি। হাতের কাজ শেষ করে দাদু ও ফুফুও এসে আমাদের সঙ্গে নৌকায় উঠলেন। দাদা থেকে গেলেন ধানের নৌকায়, আব্বা ও চাচাদের সঙ্গে। একটু পরে সবকিছু নিয়ে চলে যাবেন গাঙের ওপারে—এখন আমরা যেখানে যাচ্ছি। সেখানে আমাদের নতুন বাড়ি।
শিমুলবাঁকের বাড়িঘরের দুরাবস্থা দেখে আমার বুদ্ধিমতি দাদু আগেই সেখানে জায়গা কিনে রেখেছিলেন। একেবারে ভিটেটিটে করে সব ঠিকঠাক। নদীর ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে আমরা চলে এলাম গাঙের এপারে। নতুন ভিটেয় নতুন ঘর তুললাম। পাশাপাশি তিনটা। একটা আমাদের, একটা দাদার, আরেকটা বড় ফুফুর। এখানেই বাস করতে লাগলাম—শিমুলবাঁকের ঐতিহ্যবাহী ভূঁইয়াবাড়ি থেকে বাস্তুহারা হয়ে।
ওই বাড়ি ছিল আমার জন্মভিটে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওই বাড়িতে জন্মেছিলাম আমি। সেখানে কেটেছে আমার হাসি-কান্না আর বিস্ময়ভরা শৈশবের দিনগুলো। নদীর ভাঙনে আজ যা হারিয়ে গেছে গহিন গাঙের অতলে। কিন্তু আমার মনের আয়নায় এখনো ঝকঝক করে ওই বাড়ির চিত্রপট। স্পষ্ট হয়ে ভাসে এর ছবিগুলো। চোখ বন্ধ করে সেই আয়নায় তাকালে দেখতে পাই—হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটি শিশু এগিয়ে আসে গাঙের পাড়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে গাং দেখে। হঠাৎ করে কেঁপে ওঠে ওর পায়ের নিচের মাটি। তারপরই সব ঝাপসা হয়ে আসে।