Skip to content
মুজিব হাসান
Menu
  • মুখপাতা
  • চিন্তানুড়ি
  • গদ্যলেখা
  • স্মৃতিকথা
  • জীবনপাঠ
  • গল্পগুচ্ছ
  • ধারাবাহিক
    • উপন্যাস
    • ভ্রমণগদ্য
  • আলাপঘর
    • মুখোমুখি
    • মুখাড্ডা
  • দেরাজ
    • পাণ্ডুলিপি
    • পাঠানুভূতি
    • চিঠিপত্র
  • খোলা বই
  • বিশেষ আয়োজন
Menu

মায়াময় ভিটেবাড়ি

পোস্ট করা হয়েছে জুন ১৮, ২০২৪জুন ১৮, ২০২৪ by মুজিব হাসান

নদীর ভাঙনে হারালাম চৌদ্দপুরুষের বসতবাড়ি। শিমুলবাঁক গ্রাম ছেড়ে আমরা চলে এলাম এপারে—নতুন জায়গায়, নতুন বাড়িতে। এখানে এসে আমাদের ছোটদের আনন্দ আর ধরে না। চারদিকের পরিবেশটা কী সুন্দর! দুদিকে দুটো গাং। উত্তরে ঘোড়াউত্রা, অনেকটা মরামতো; দক্ষিণে ধনু, স্রোতময় ঢেউখেলানো। মাঝখানে উর্বর ভূমির একখণ্ড চর। ঘাসফড়িংয়ের মাঠ, সোঁদা মাটির পথ, ধান-বাদাম আর মাষকলাইয়ের খেত। রুপোর ফিতের মতো একটা খালও আছে। কী স্বচ্ছ আর টলটলে তার পানি!

আধা দিন রোদে পুড়ে আংরা হয়ে ভরদুপুরে ওখানে গিয়ে গোসল করি। দলবেঁধে যাই—আমি, সরমিন আপা, বাবন আপা আর পাশের বাড়ির কয়েকটি ছেলেমেয়ে। দাপাদাপি করে নাইতে নামি। নতুন পানির তেজে চোখ লাল হয়ে যায়। তখন এই লালাভের দোষ সম্পাত করি কাকের ওপর—আমার চউখ কালা, কাউয়ার চউখ লাল… জোরে জোরে চোখ চাপা দিয়ে এই শাপমন্ত্র জপে জপে বাড়ির পথ ধরি।

দশ-বারোটার মতো পরিবার নিয়ে এই পাড়াগাঁ। সবাই ডাকে ময়নাহাটি, আমরা বলি হেইপার। পুরো পাড়াজুড়ে তখন একটি টিউবওয়েল—আমাদের বাড়িতে। পাড়ার বৌ-ঝিরা সকাল-বিকেল দলবেঁধে এখান থেকে পানি নিতে আসে। আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি একমাত্র সম্ভার। আমরা উদার মনে সবাইকে পানি দিই। কারও ছেলেপিলের সঙ্গে ঝগড়া হলে তারা যদি পানি নিতে আসে, তাহলে তাদের বকে দিই আচ্ছেমতো। এতে কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে বড়দের কাছে নালিশ করে যায়। তারা আমাদের ধমকে দেন।

আমাদের এপারের বাড়িটা একটু আলাদা, আলগা ভিটেয় অবস্থিত। শুকনাকালে নামা দিয়ে আর বর্ষাকালে বাঁশের সাঁকো দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। চারপাশে দেশি ফলমূলের গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, বরই, আতা, জাম্বুরা, বিচিকলা, সবরিকলা প্রভৃতি গাছগাছালি বেড় দিয়ে লাগানো। আম্মার ঘরের পেছনে একটা বড় জাংলা। ঝিঙা, শিম, লাউ, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পুঁইশাক প্রভৃতি শাকসবজির মাচান।

বাড়ির সামনে একটা বিশাল পগার। ওখানে আমাদের আর আশেপাশের বাড়িঘরের হাঁসগুলো সাঁতার কাটে। মাঝে মাঝে ডিম পাওয়ার লোভে আমরাও সাঁতরাই। এর অদূরে গাঙের পাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ঢোলকলমির ঝোপ আর বিন্নের বন। ওখানে ঝোপের ভেতরে চড়ুই, শালিক, টুনটুনিরা এসে বাসা বাঁধে। মাঝেমধ্যে আমরা ডিম আর ছানার লোভের ওই বাসাগুলোতে জেট হামলা করে বসি।

এপারে এসে আমাদের সকাল কাটে বাড়িতে বসে, দুপুর কাটে ঘাসফড়িংয়ের মাঠ আর রুপোর ফিতের খালের পানিতে। বিকেল হলেই মেতে উঠি খেলায়। কত রকমের খেলা! গাছদৌড়, কাবাডি, দারিয়াবান্দা, গোল্লাছুট, ফুলটোকা আরও কত কী! তবে বেশি মজা পেতাম ঝোপের ভেতর লুকোচুরি খেলায়—এলাকার ভাষায় যাকে বলতাম ‘পলামঞ্জি’।

সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত, কিন্তু খেলার নেশায় এতই বিভোর থাকতাম, ঘরে ফেরার কথা মনেই থাকত না। যে জন্য রাত করে বাড়ি ফিরলে বড়দের মুখে প্রায়ই বকা খেতাম। তারা ডরভয় দেখাতেন, সন্ধ্যাবেলায় বাইরে থাকতে নেই। ওই সময় ভূত-পেতনিরা ছোটাছুটি করে। তখন কাউকে বাইরে পেলে তাকে বন্দি করে নিয়ে যাবে পেতপুরিতে। এ কথায় দুয়েক দিন সময় করে ঘরে ফিরতাম। কিন্তু আবার যখন খেলার নেশা পেয়ে বসত, তখন মনে হতো—আসুক ভূত-পেত, ওদের রাজ্যকে ছারখার করে দেব!

ময়নাহাটি এসে এভাবে কেটে গেল দুটো বছর। হাসি-আনন্দ, ঘোরাঘুরি আর খেলাধুলা করে। হঠাৎ এক বর্ষায় স্তিমিত হয়ে যায় সব। সেবার বেশ আগেভাগেই বর্ষা চলে এলো। বোশেখের মাঝামাঝিতে শেষ হয়েছিল ধানমাড়াই। নয়তো খুব বিপাকে পড়তে হতো। দুপাশের দুই গাং ছাপিয়ে, হাওড় ভাসিয়ে ভাসান পানির স্রোত আছড়ে পড়ল বাড়ির নামায়। বসতবাড়ির চারপাশে ঘায়েল দেওয়া হলো। কিন্তু পানির তোড় প্রতিদিন বাড়তেই লাগল। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াল—ঘায়েল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়বে বাড়ির ভেতরে। বোঝা গেল, এবার আমাদের বন্যার মুখে পড়তে হবে।

এর মধ্যে পড়েও গেলাম। ভাসান পানি ঘায়েলের সমান হয়ে গেল। তখন বসতবাড়ি টিকিয়ে রাখার জন্য শুরু হলো সংগ্রাম। এই সংগ্রামের অগ্রসেনানী বাড়ির বড়রা। তারা প্রতিদিনই নৌকা দিয়ে জলস্রোতে ভেসে যাওয়া কচুরিপানা আর পানিকোলার ঝাড় নিয়ে আসেন। ওগুলো ঘায়েলে দিয়ে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। ভাসান পানির সঙ্গে এভাবেই সংগ্রাম করতে থাকি। এরকম করে কেটে যায় তিনটা মাস। কিন্তু ততদিনেও পানি কমার নামগন্ধ নেই। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বানের জল।

একদিন সকালবেলা। দাদার ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিরাট সর্বনাশের কাণ্ড। দাদার ঘরে পানি ঢুকে গেছে। বাড়ির, উঠান, বাইরেগ, রান্নাঘর, বড়ঘর, চৌকি ও গোলার তল পর্যন্ত বন্যার ঘোলে পানি। ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে মাটির চুমো হারিয়ে ওই পানিতে নেমে পড়ি। ঘর থেকে বাইরে আসি। দেখি ময়নাহাটির পুরোটা ভেসে গেছে বানের জলে।

পানি ভেঙে আমাদের ঘরে যাই। এখানে পানি ঢুকেনি, তবে ভিটে ছুঁইছুঁই করছে। বড় ফুফুর ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওই ঘরও ভেসে গেছে বানের পানিতে। চৌকির ওপর বসে হাউমাউ করছে সরমিন আপা, বাবন আপা, বাবলু, তৃপ্তি। ওদের চ্যাঁচামেচিতে আমিও যোগ দিই। চৌকির ওপর বসে বড়শি দিয়ে পুঁটি, বেলে আর টেংরা মাছ মারি। মাঝেমধ্যে দেখি ঘরের বেড়ার ফাঁক-ফোঁকরে আশ্রয় নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ছোটবড় সাপ। এর কোনোটিকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠি, কোনোটিকে আচ্ছেমতো লাঠিপেটা করি। পানিতে ভাসা ঘরে এভাবেই কেটে গেল এক দিন এক রাত।

পরদিন সকালবেলা। ঘাটে এসে ভিড়ল একটা বড় নৌকা। তাতে বোঝাই করা হলো বস্তাভরা ধান আর দাদুর শখের হাঁড়িকুড়ি। এই নৌকায় উঠলাম আমি, দাদা-দাদু, আর ফুফাতো ভাই বাবলু। আমরা এখন চলে যাচ্ছি ওই পারে, পাশের গ্রাম বড়িবাড়িতে। মালবোঝাই নৌকা বন্যার কালচে পানির বুক চিরে চলতে লাগল। বাড়ির বউ-ঝিদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো শিমুলবাঁক। কয়েকদিনের জন্য আমাদের আত্মীয়ের বাড়িতে। ওদের মধ্যে আমার ছোট বোন আনিকা আর কচি ভাই রনিকও আছে। শুধু আমরা চারজন আর পরে দুই চাচা চলে এলাম বড়িবাড়ি। বন্যার কবলে হারালাম মায়াময় ভিটেবাড়ি। চলে এলাম নতুন ঠিকানায়।

ওই বাড়ির মায়ায় আজও আমার মন কাঁদে, এখনো পরান পোড়ে। দূর থেকে ওদিকে তাকালে মনে হয়, স্মৃতির ওই ভিটেখানি হাতছানি দিচ্ছে আমাকে। ঘাসফড়িংয়ের মাঠ, রুপোর ফিতের খাল আর ধান-বাদামের খেতগুলো হাহাকার করে ডাকছে—আয়রে দামাল, আয়!

মন্তব্য করুন

আরও লেখা :

  • মোহন সন্ধ্যার সাহিত্...

    মোহন সন্ধ্যার সাহিত্...

    জলধোয়া আয়নার মতো শরত...
  • ডায়েরির দাগগুলো

    ডায়েরির দাগগুলো

    আমি তখন পনেরো পেরোনো...
  • আনসারনগরে, পুণ্যস্মৃ...

    আনসারনগরে, পুণ্যস্মৃ...

    শীতের সকাল। আকাশের জ...
  • পাঠ্যবইয়ের আমোদ

    পাঠ্যবইয়ের আমোদ

    বই পড়া নিয়ে যখন স্মৃ...
শেয়ার করুন
Amar Kotha

আমি মুজিব হাসান। আমার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় এলাকার এক কৃষক পরিবারে। দিনটি ছিল ১৩ বোশেখ—নতুন ফসল ঘরে তোলার আমেজময় সময়। বাপদাদার পেশা হাওড়ের চাষাবাদ আর গাঙের জলমহাল। আমার ইচ্ছা লেখালেখিকে নিজের পেশা হিসেবে বরণ করে নেব। এ দেশে কলমকারি করে জীবিকা নির্বাহ করা যদিও বেশ কঠিন কাজ, তবুও এ ইচ্ছা জিইয়ে রাখব।

পড়াশোনার পুরোটা কওমি মাদরাসায়। জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ থেকে দাওরায়ে হাদিস, এরপর জামেয়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামে আরবি সাহিত্য পড়েছি। করোনা মহামারির সময়টায় শুরু করেছি কর্মজীবন। প্রকাশনায় কাজের ইচ্ছা থেকে বর্তমানে সম্পাদনার কাজবাজ করছি। এছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো এখনো কোনো পাটাতন তৈরি করতে পারিনি।

হাওড়ের জীবন, প্রকৃতি ও মানুষ দেখে জেগেছে আমার লেখালেখির বোধ। জীবনের প্রথম রচনা একটি খুদেগল্প—লিখেছিলাম মক্তব সুওমে পড়ার সময়। মক্তব পাঞ্জম থেকে শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ডায়েরি আর ছড়া-কবিতা ছিল আমার নিত্য কলমকারি। হেদায়াতুন্নাহু জামাতে পড়ার সময় গল্প-উপন্যাস রচনায় হাত দিই। এক খাতায় এক বসাতে লিখতাম আস্ত উপন্যাস!

স্কুল-মাদরাসার পাঠ্যবইগুলো আমার সাহিত্য পাঠের প্রথম জোগান। শহুরে পরিবেশে এসে বই পড়ার দিগন্ত আরও প্রসারিত হলো। মাদরাসার সাহিত্য পাঠাগার, পাবলিক লাইব্রেরি, বইয়ের দোকানে ছিল নিত্য যাতায়াত। গল্প-উপন্যাস পড়তে বেশি ভালো লাগে। কবিতা আমার অবসরের সঙ্গী। কুরআনের তাফসির ও জীবনী সাহিত্য বেশ টানে। খুব রয়েসয়ে পাঠ করি চিন্তামূলক রচনাগুলো।

পৃথিবীর বুকে আমি একটি নুক্তা কিংবা নুড়ি। বয়স ও সময়ের ঘর্ষণে ক্ষয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। চিহ্নপত্রে নিজেকে নিয়ে বলার মতো এটুকুই কথা। বাকি সব বকওয়াজ।

ফেসবুকে আমি

এটা আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
অনুমতি ছাড়া এখান থেকে কোনো লেখা বা ছবি কপি করা অন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

<
.

নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

© ২০২৫ মুজিব হাসান