শীতের সকাল। আকাশের জাফরি গলে চুঁইয়ে পড়ছে দইয়ের ঘোলের মতো কুয়াশা। ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে আনছে বরফকুচির আর্দ্রকণা। এক চাকতি কমলালেবুর মতো সূর্য ছড়াচ্ছে কুসুম রোদ। প্রকৃতির এরকম দৃশ্যপট দেখতে দেখতে আমরা রওনা হলাম আনসারনগরের উদ্দেশে। বাংলার সিরাত সাহিত্যের জনক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর আনসারনগরে, তার পুণ্যস্মৃতির খোঁজে।
মাওলানা খানকে আমি চিনেছি তার সাড়াজাগানো আত্মজীবনী ‘জীবনের খেলাঘরে’ বইটি পড়ে। ভাবি, একজন মনীষীকে তার আত্মজীবনী পাঠের মাধ্যমে চেনা অনেক বড় ব্যাপার। বইটি পড়ে আমার এরকম অনুভূতি হয়েছে। জীবনের খেলাঘরের মতো এমন ঘোর লাগা বই খুব কম পড়েছি। মাওলানার হৃদয় নিংড়ানো কথামালার সম্মোহন আমাকে দারুণ অভিভূত করেছে। কিশোর-হৃদয়ের আরশিতে ফেলেছে বিমুগ্ধ প্রতিবিম্ব। তাই যতবার এই বইটি পড়ি, এর আলোকচ্ছটায় হৃদয়জগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারটা আমাকে নিদারুণ মর্মাহত করে—আমি মাওলানা খানের সময়কাল পেয়েছি, কিন্তু তার সাক্ষাৎ পাইনি। এটা আমার জীবনের চরম আক্ষেপ। মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহে সেই আক্ষেপ আজ রূপান্তরিত হলো পরম সৌভাগ্যে। মাওলানা খানের ভাবশিষ্য, তাকে হৃদয় দিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং তার আদর্শ ধারণ করা মানুষটি মাওলানা আবদুর রহিম ইসলামাবাদী—যার সাক্ষাৎ আমার কাছে মাওলানা খানের সাক্ষাতের পরিপূরক—এই জীবন্তিকার সঙ্গে চলেছি মাওলানার স্মৃতিপীঠ আনসারনগরে।
এই বয়সে যেসব মনীষীর সান্নিধ্যের সৌরভে বিপুল বিমোহিত হয়েছি, তাদের অন্যতম মাওলানা আবদুর রহিম ইসলামাবাদী। ক্ষণিকের দেখায় অচেনা মানুষকে চিরআপন করে নেওয়ার অনন্য গুণ তার মধ্যে রয়েছে। শাহ সাহেব হুজুর রহ.-এর স্মারকের কাজে চট্টগ্রাম সফরকালে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ও সাক্ষাৎ। সেদিন এক প্রহর সময় আমরা তার সান্নিধ্যে ছিলাম। আমাদের মতো কেউকেটার প্রতি তিনি যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, এর বারিধারায় হৃদয় এখনো সিক্ত হয়ে আছে।
চট্টগ্রাম থেকে ফেরার ঠিক এক সপ্তাহ পর, যে টান নিয়ে আমরা তার কাছে গিয়েছিলাম—বললে অত্যুক্তি হবে না—সেরকম টান নিয়ে তিনি এসে হাজির হলেন কিশোরগঞ্জ, আমাদের বর্তমান আবাস জামিয়া ইমদাদিয়ায়। তার আগমনের কথা জানতে পেরে জলদি গিয়ে সাক্ষাৎ করলাম। মাওলানা ইসলামাবাদী পরম আত্মীয়ের মতো জড়িয়ে ধরলেন আমাদের।
কুশল বিনিময়ের পর জানলাম, তিনি গফরগাঁও যাবেন। সেখানে মাদানি রহ.-এর খলিফাদের একটি ইসলাহি মাহফিল হচ্ছে, এ উদ্দেশ্যে তিনি দাওয়াতি মেহমান হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। মাওলানা ইসলামাবাদী আমাদের তার সফরসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি আর খাইরুল ভাই সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম।
দুদিনের সফরের প্রথম দিন কেটে গেল গফরগাঁওয়ের গলাকাটা গ্রামে, মুফতি আনোয়ার মাহমুদ সাহেবের বাড়িতে, ইসলাহি ইজতেমায়। দ্বিতীয় দিন সকালে রওনা হলাম মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর স্মৃতিপীঠ আনসারনগরে, তার কবরগাহে হাজিরা দিতে।
কুয়াশা কেটে গিয়ে সকালের মিষ্টি রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। গলাকাটা বাজার থেকে রিকশায় করে পালের বাজার পেরিয়ে আমরা এসে নামলাম মাওলানা খানের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা আনসারনগর গণকল্যাণ ট্রাস্টে। মাদরাসার পরিবেশ আটপৌরে গ্রামীণ হলেও বেশ সুন্দর। টুকটাক নির্মাণ কাজ চলছে। ছাত্র-শিক্ষক তেমন নেই। একজন শিক্ষককে পাওয়া গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম মাওলানা খানের কবর কোথায়? তিনি এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিলেন মাওলানার পারিবারিক কবরস্থান।
মাদরাসার পাশে এর অবস্থান। এখানে হাসনাহেনা ঝাড়ের নিচে শুয়ে আছেন বাংলার সিরাত সাহিত্যের জনক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.। উঁচু ঢিবির মতো কবর, কোনো নামফলক নেই, একেবারে সাদাসিধে। অচেনা কেউ এলে হয়তো জানতেই পারবেন না—এখানে শুয়ে আছেন একজন কিংবদন্তি মনীষী। মাওলানা ইসলামাবাদীর পেছনে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা ও সুরা ইখলাস পড়ে তার নামে ইসালে সওয়াব করলাম।
জিরায়ত শেষে ওই শিক্ষকের থেকে জানতে পারলাম, মাওলানা খানের ছোট ছেলে, মাসিক মদীনার বর্তমান সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দীন খান আছেন মাদরাসায়। কিছুক্ষণ আগে এসেছেন তিনি। অফিসরুমে বসে আছেন। মাওলানা ইসলামাবাদীর সঙ্গে সেখানে গেলাম। তাকে দেখতে পেয়ে আহমদ খান ঝলমলে চেহারা নিয়ে ছুটে এলেন। পিতার ভাবশিষ্য মাওলানা ইসলামাবাদীর প্রতি তিনি খুব শ্রদ্ধা দেখালেন। তার কল্যাণে আমাদের আবারও যেতে হলো মাওলানা খানের কবর জিয়ারতে।
জিয়ারত শেষে মাদরাসার অফিসে বসলাম সবাই। মাওলানা ইসলামাবাদী এবং আহমদ খানের মাঝে শুরু হলো প্রাণবন্ত আলাপ। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ হলো। আপন মানুষের মুখ থেকে প্রিয় মনীষীর স্মৃতিপীঠে বসে তার স্মৃতিচারণ শোনার মতো সুখকর আর কিছু হয় না। তাদের আলাপচারিতা শুনতে শুনতে আমরা এটিই অনুভব করছি। আহমদ খানের ব্যক্তিত্ব তার পিতার প্রতিবিম্ব বলে মনে হলো। তিনি মাওলানা খানের সিরাতের ওপর অনন্য কাজের এই চমৎকার ঘটনাটি শোনালেন—
মদিনা মুনাওয়ারার একটি প্রকাশনা থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের গোটা জীবনের ওপর সন-তারিখ এবং সময়-সহ একটি সিরাত বিশ্বকোষ প্রকাশিত হচ্ছে—যেটি সমাপ্ত হবে ২৫ শ খণ্ডে আর প্রত্যেক খণ্ডে থাকবে ১ হাজার পৃষ্ঠা। ইতোমধ্যে এর ১১ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।
এই বিশ্বকোষের ৫ম খণ্ডে মাওলানা খানের একটি দীর্ঘ লেখা—যার পুরোটা তিনি আরবিতে লিখেছিলেন এবং এটি স্বতন্ত্র বইয়ের উপযোগী—আছে। এটি তাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। অচিরেই মদীনা পাবলিকেশান্স থেকে প্রকাশিত হবে। এছাড়া মাওলানা খান যেসব চিঠিপত্র লিখে গেছেন, সেগুলো প্রায় ৩ হাজার পৃষ্ঠার মতো হয়েছে। এটিও বই হিসেবে আসছে। সেইসঙ্গে আসছে তার জীবন ও কর্মের ওপর বিশাল কলেবরে স্মারকগ্রন্থ।
এরমধ্যে সবার জন্য চা-নাস্তা চলে এলো। চা-চক্রে বসে আহমদ খান শোনালেন এই আশ্চর্য ঘটনাটি—
মাওলানা খান জীবনের খেলাঘরের দ্বিতীয় খণ্ড লিখেছিলেন। প্রথম খণ্ড যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, এরপরের ঘটনাপুঞ্জ থেকে জীবনের শেষ সময়ের আগপর্যন্ত তিনি ধারাবাহিক লিখেছেন। সেটি প্রকাশের উপযোগী হয়ে ছিল। এর মধ্যে মাওলানা খান অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলেন হাসপাতালের বেডে।
মৃত্যুর বেশ কয়েকদিন আগে তিনি ওই পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষণের জন্য চাইলেন। আহমদ খান এটি দিয়ে এলেন তার হাতে। তিনি পরদিন গিয়ে দেখেন, মাওলানা খান পুরো পাণ্ডুলিপি নিজ হাতে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফ্লোরে ফেলে রেখেছেন। আহমদ খান অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন। মাওলানা বললেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে আমার এ লেখার কারণে হয়তো উম্মতের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হবে। তাই এটা যাতে না হয়, সেই কারণে নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।’
ততদিনে মাসিক মদীনায় জীবনের খেলাঘরের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের ঘোষণা হয়ে গেছে। মাওলানাকে এটা জানানো হলে তিনি বললেন, ‘তাহলে আমি ‘যাযাবরের রোজনামচা’ শিরোনাম দিয়ে অনেকগুলো লেখা লিখেছিলাম, সেগুলো দিয়েই জীবনের খেলাঘরে দ্বিতীয় খণ্ডটি করে ফেলো।’ সেটিই এখন বই হয়ে আসছে মদীনা পাবলিকেশান্স থেকে।
এই অবাককর কাহিনি শুনে আমি আর খাইরুল ভাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মাওলানা ইসলামাবাদী কী যেন মনে করে মাথা নাড়লেন।
জোহরের আজান হয়েছে। মাদরাসার মসজিদে নামাজ পড়লাম। বাদ নামাজ আমরা ফিরতে চাইলাম। আহমদ খান জানালেন দাওয়াতের কথা। মাওলানা খানের ছোট ভাই সালাহউদ্দীন খান মাওলানা ইসলামাবাদীর আগমনের কথা শুনে বাড়িতে খাবারের আয়োজন করেছেন। সেটি রক্ষা করে যেতে হবে। শুনে আমরাও খুশি হলাম। যাক, এই ফাঁকে তাহলে মাওলানা খানের বাড়িও দেখে যেতে পারব।
বাড়িতে টুকটাক নির্মাণ কাজ চলছে দেখে মাদরাসার অফিসরুমে খাবার নিয়ে আসা হলো। সবজি, ডিম, গোশত আর ডাল। রান্না এত বেড়ে হয়েছে, সবাই একেবারে চেটেপুটে খেয়েছি। খেতে খেতে আহমদ খান জানালেন, তার চাচির হাতের রান্না এমনই সুস্বাদু হয়। যে খায়, সে-ই দারুণ প্রশংসা করে।
খাওয়ার পর একটু জিরিয়ে গেলাম মাওলানা খানের বাড়ি দেখতে। মাদরাসা থেকে একটু দূরে তাদের বাড়ি। মাওলানা খান যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন, সেটি দেখলাম। পুরনো হলেও বেশ আলিশান ঘর। দেখলাম, একটি নতুন দুতলা ভবন হচ্ছে। মাওলানার মায়ের নামে। মাওলানা খানের ছোট ভাই সালাহউদ্দীন খানের বাড়ির উঠানে সবাই একসঙ্গে চা-চক্রে বসলাম। এখানেও মাওলানা খানের জীবন ও পূর্বপুরুষদের ওপর অনেক স্মৃতিচারণ হলো।
সারা দিন কেটে গেল মাওলানা খানের স্মৃতিবিজড়িত আনসারনগরে। এবার বিদায়ের পালা। মাওলানা ইসলামাবাদী রাতের গাড়িতে চট্টগ্রাম চলে যাবেন। আহমদ খানও বিকেলের ট্রেনে চলে যাবেন ঢাকায়। রওনা দেওয়ার আগে সবাই আরেকবার হাজিরা দিলাম কিংবদন্তি মনীষী মাওলানা খানের কবরগাহে। এবার আহমদ খানকে বললাম নামফলকের ব্যাপারটা। তিনি জানালেন, কিছুদিনের মধ্যে এটা করবেন। রিকশা ডাকা হলো। আমরা পাঁচবাগ হয়ে—মাওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী রহ.-এর কবর জিয়ারত করে—যাব কিশোরগঞ্জ। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম সেদিকে।
পালের বাজারের হাওয়ায় ভর করে রিকশা চলছে পাঁচবাগের দিকে। বিকেলের কমলা রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। চলতি রিকশা থেকে একবার পেছন ফিরে তাকালাম। হাসনাহেনার ঝাড়ের নিচে মাওলানা খানের কবরটিকে শেষবারের মতো দেখে নিলাম। মনে হচ্ছে কী যেন একটা ফেলে যাচ্ছি। কী সেটা?
পুণ্যস্মৃতির মায়া! এর টানে আমাদের আবারও আসতে হবে বাংলার সিরাত সাহিত্যের জনক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর কবরগাহে হাজিরা দিতে। আল্লাহ তায়ালা তার কবরকে রহমতের বারিধারায় সিক্ত করুন, তাকে দান করুন জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ স্থান!