আমি তখন পনেরো পেরোনো কিশোর। তাড়াইল সাচাইল মাদরাসায় নাহবেমির জামাতে পড়ি। লজিং থাকি মামার বাড়িতে। সকাল আটটায় খাবারের ছুটি হয়। প্রতিদিন বেরোনোর সময় হাতে করে একটি বই নিয়ে যাই। পড়ি আর হাঁটি; যাওয়া-আসার পুরোটা সময় ডুবে থাকি বইয়ের ভেতর। বিকেলে মামার দোকানে গিয়ে পত্রিকা পড়ি। রাতে ইশার পরে করি টুকটাক লেখালেখি। রোজনামচা লেখা হয় নিয়মিত। ছড়া-কবিতা লেখা হয় বেশি। কখনো কখনো দুয়েকটা ছোটগল্পও লেখা হয়ে যায়।
এক বিকেলে মামার দোকানে গেলাম পত্রিকা পড়তে। দেখি প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান নিয়ে একটি নিউজ ছাপা হয়েছে। ঢাকার শাহবাগ চত্বরে একত্রিত হয়েছে একদল প্রগতিশীল নারী-পুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দাবি করছে। একেবারে অনড় অবস্থান নিয়েছে তারা। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছে অনেকেই। নিউজে বিষয়টিকে ইতিবাচক করে তুলে ধরা হয়েছে। তাই এটি আমার কিশোর মনেও ছাপ ফেলল।
কিছুদিন পরে পড়ি আরেকটি নিউজ—এক ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। সে নাকি ইসলাম ও নবিজিকে নিয়ে জঘন্য কটূক্তি করেছে। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ব্লগার হত্যার বিষয়টিকে হাইলাইট করে নিউজ ছেপেছে। অন্যদিকে আমার দেশে ছাপা হয়েছে এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ। একদল মুক্তমনা নাস্তিক ব্লগার আল্লাহ, রাসুল, কুরআন, সাহাবা, উম্মাহাতুল মুমিনিন, ইসলামের বিধিবিধান প্রভৃতি নিয়ে ব্লগে ব্যাঙ্গাত্মক লেখালেখি করেছে। সেসব লেখার কার্টিংগুলো নিয়ে ছাপা হয়েছে এ নিউজ। এটি দেশজুড়ে বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব আলোড়ন তোলে। নিউজটির জন্য আমার দেশ পত্রিকার সেই সংখ্যাটির কাটতি পড়ে যায়। অনেকেই এটি ফটোকপি করে প্রচার করে নাস্তিক ব্লগারদের ঔদ্ধত্য সম্পর্কে মানুষকে সজাগ ও সতর্ক করে।
এ নিয়ে তখন গোটা দেশই উত্তাল। সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হন কওমি আলেমগণ। তখনই প্রথম শুনি আল্লামা শাহ আহমদ শফির নাম। দেশের প্রায় সব আলেমের মুরব্বি তিনি, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। জাতির এ চরম দুরাবস্থায় কাণ্ডারি হয়ে এগিয়ে আসেন। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে সংবিধানে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা বহাল, ইসলামবিরোধী সব কর্মকাণ্ড বন্ধ এবং নাস্তিক ব্লগারদের ঔদ্ধত্যের সমুচিত শাস্তির দাবি জানান। এজন্য হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে সরকারের কাছে পেশ করেন ১৩ দফার প্রস্তাবনা। তার নির্দেশনায় মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষজন এ ইস্যুতে সরব হয়ে ওঠেন। পাড়াগাঁয়ের চা-স্টল থেকে জাতীয় সংসদ—সব জায়গায় চলতে থাকে হেফাজতে ইসলামের আলোচনা। এভাবেই তা তথাকথিত গণজারগরণকে ছাপিয়ে মহাগণজাগরণের রূপ নেয়; দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
দুই.
গোটা দেশ তোলপাড় করা এ ইস্যুটি আমার কিশোর মনে নিদারুণ দাগ কাটে। নাস্তিক ব্লগারদের ব্যাঙ্গাত্মক লেখার কার্টিংগুলো পড়ে খুবই মর্মাহত হই। বিশেষ করে আল্লাহ ও নবিজিকে নিয়ে ওদের কটূক্তিগুলো এত স্পর্ধিত ও অকথ্য ছিল, যা ইসলামপ্রিয় শিক্ষিত ও সাধারণ সকলকে অত্যন্ত ব্যথাতুর করে তোলে। ওদিকে গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমও দিনদিন বেলেল্লাপনায় রূপ নিতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনাকে পুঁজি করে তারা জাগরণ নামের আসর বসিয়েছে, সেখানে ঢুকে পড়ে ইসলামবিদ্বেষ, দাড়ি-টুপিওয়ালাদের প্রতি বিষোদ্গার এবং অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ। মুক্তমনা ও বাম ঘরানার লোকেরা মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক দেখলেই বাঁকা চোখে তাকায়, খোঁচা মেরে কথা বলে। এসব দেখে সেসময়ই বুঝতে পারি, ওদের আর আমাদের মধ্যকার তফাতটা খুব বিশাল!
আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলাম—দুটোই তখন সমুচ্চারিত নাম; চেতনাজাগানিয়া মহাজাগরণের উদ্দীপক শ্লোগান। আমরা দরসে, তাকরারে, অবসর সময়েও আহমদ শফি এবং হেফাজতে ইসলাম নিয়ে কথাবার্তা বলি। হেফাজতের ১৩ দফা সম্বলিত লিফলেট টানিয়ে রাখি রুমের দরজায়; গুঁজে রাখি খাতায়, কিতাবের ভাঁজে। হেফাজতের আলোড়ন আর আহমদ শফির নির্দেশনার খবর জানতে সবাই তখন উন্মুখ। প্রতিদিন বিকেলে মাদরাসামার্কেটের দোকানগুলোতে গিয়ে পত্রিকা পড়ি। টিভিতে খবর শোনার জন্য কেউ কেউ চলে যায় আত্মীয়ের বাসায় কিংবা লজিংবাড়িতে। আর এভাবেই একদিন পেয়ে যাই লংমার্চের ঘোষণা। ৬ এপ্রিল ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে হবে এ লংমার্চ। দেশের তৌহিদি জনতাকে সেখানে শরিক হতে আহ্বান জানান আমিরে হেফাজত আল্লামা শাহ আহমদ শফি।
হেফাজতের এ লংমার্চের ঘোষণায় চারদিকে আলোড়নের বাতাস বয়ে যায়। এর হিল্লোল আমার মনেও দিয়ে যায় দারুণ দোলা। আমাকে পেয়ে বসে এক অপূর্ব ঘোর। এবার হেফাজত বিষয়ক প্রতিটি খবর খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি ও শুনি; লিখিত কিছু পেলে সযত্নে রেখে দিই ডায়েরি কিংবা তোরঙ্গের ভেতর। ১৩ দফা দাবির লিফলেটের পর দাবিগুলোর ব্যাখ্যাসম্বলিত আরেকটি লিফলেট প্রচারিত হয়; সেটিও যত্ন করে রেখে দিই। দৈনিক পত্রিকার মধ্যে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, ইনকিলাব হেফাজতের ইস্যুটিকে ইতিবাচক করে নিউজ ছাপে। মাদরাসার অফিসে এগুলো নিয়মিত রাখা হয়। সময় পেলে আমরা গিয়ে পড়ে নিই। সাপ্তাহিক লিখনীর তখন রমরমা প্রচার। মাদরাসামার্কেটের এক লাইব্রেরিয়ান সপ্তাহে একটি করে সংখ্যা আনে। তার সাথে একটু খাতিরদারি থাকায় না কিনে পড়ে নিই। লিখনীর প্রতিটি লেখাই চম্বুকের মতো ধরে রাখে। মাসিক পত্রিকার মধ্যে রহমত, আলকাউসার, রাহমানী পয়গাম, আদর্শ নারী, মহিলাকণ্ঠ—এগুলোতে পাই নানামাত্রিক রচনা। এভাবে মেটাতে থাকি পাঠের খিদে।
আমাদের দিনরাতের বেশির ভাগ মুহূর্ত কেটে যায় হেফাজতের খবরাখবর নিয়ে পাঠচক্র করে। আমি সেখানে থাকি শ্রোতার ভূমিকায়। মুখচোরা হওয়ার কারণে তেমন কথাবার্তা বলি না। তবে রাতে ইশার পর যখন ডায়েরি নিয়ে বসি, তখনই সমস্ত অব্যক্ত কথা এসে ভিড় করে কলমের ডগায়। যে পাতাগুলো ভরে উঠত দিনযাপনের টুকিটাকিতে, সেখানে ফুটতে থাকে উদ্দীপ্ত মনের আঁচড়। এমনই এক উদ্দীপনার ঘোরে একদিন লেখা হয়ে যায় এ গীতিকবিতাটি—
আলোড়ন
আলোড়ন আলোড়ন আলোড়ন
জেগে ওঠার এই আলোড়ন!
জাগো হে বন্ধু, কণ্ঠে তোলো
সিংহের ক্ষ্যাপা গর্জন
দৃপ্ত শ্লোগানে জাগিয়ে তোলো
জনতার সুপ্ত মন।
এই আলোড়ন গর্জে ওঠার
এই আলোড়ন বেঁচে থাকার
এই আলোড়ন চিরকালের
এর নেই কোনো অবসান!
সত্য-ন্যায়ের এই আলোড়ন
লাখো মুমিনের অভিযান
বাতিল দমনে প্রলয়ের ত্রাস
মানবতা-মুক্তির জয়গান।
এই আলোড়ন কওমি উলামার
এই আলোড়ন সিংহ থাবার
এই আলোড়ন অধিকারের
ঘুমন্ত জাতির জাগরণ!
আল-কুরআনের এই আলোড়ন
নবিপ্রেমীদের আস্ফালন
বাংলার বুকে রুখে দিতে
নাস্তিকদের আগ্রাসন!
এই আলোড়ন নারীনীতি তাড়নের
এই আলোড়ন শাহবাগী দমনের
এই আলোড়ন নাস্তিক নিধনের
হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন!
তিন.
লংমার্চ শব্দটির সাথে সেসময়ই আমার প্রথম পরিচয়। শুরুর দিকে এর অর্থটি বুঝিনি। তখন এক সহপাঠী নিজের বুঝমতো আমাকে বুঝিয়ে দেয়—লংমার্চ মানে লম্বা মিছিল; যেখানে অনেক মানুষ একত্রিত হয়ে বিশাল মিছিল নিয়ে বের হয়। শাব্দিক অর্থ না জানলেও এর ভাব ও বৈশিষ্ট্য ঠিকই উপলব্ধ হয়ে যায়। বুঝতে পারি, এ লংমার্চ মানে প্রিয় নবির ইজ্জত রক্ষার মিছিল। যারা ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছে, সেসব নাস্তিক-মুরতাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়ার মিছিল। আর হেফাজতে ইসলামের এ লংমার্চে অংশগ্রহণ করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব।
সময় গড়িয়ে যায়। দিনরাতের পালাবদল ঘটিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে ৬ এপ্রিল তারিখটি। লংমার্চ নিয়ে কথাবার্তায় সরগরম হয়ে ওঠে আমাদের নেজামুল আওকাতের মুহূর্তগুলো। কিন্তু সবার সাথে আড্ডায় বসলেও আমি নিজের মুখচোরা স্বভাবটি ধরে রাখি। বলি না কিছুই, কেবল শুনে যাই। মনের মাচায় যেসব কথার পুঁই গজায়, একান্ত সময়ে সেগুলোর লতা আঁকি ডায়েরিতে কিংবা রোল টানা খাতায়। একদিন বাংলা হাতের লেখা লিখছি। তখনই মাথায় এল একটি গল্পের প্লট। আধখেঁচড়া করে সেখানেই লিখে ফেলি। এ গল্পটি লংমার্চ পূর্ববর্তী সেই সময়টাকে উপজীব্য করে লেখা—
তপ্ত আহ্বান
তেরো বছরের এক কিশোর। নাম তার আবিদ। চিকন গড়ন, উজ্জ্বল চোখ, মায়াবী মুখ। আচার-ব্যবহারে নম্রভদ্র ও শান্তশিষ্ট। আট বছর বয়সে কুরআনুল কারিম হিফজ করেছে। এখন গ্রামের মাদরাসায় নাহবেমির জামাতে পড়ছে। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত ভালো। পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী। ক্লাসের সিরিয়ালে সবসময় প্রথম হয়। এ কারণে উস্তাদরা তাকে খুব স্নেহ করেন। সহপাঠীরাও সমীহ করে।
বুকভরা আশা নিয়ে বাবা আবিদকে মাদরাসায় দিয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল, ছেলে হাফেজ-আলেম হবে; দীনের খেদমত করবে। ওয়াজ মাহফিলে এক আলেমের বয়ানে শুনেছিলেন—একজন হাফেজ-আলেমের পিতাকে হাশরের মাঠে স্বর্ণখচিত আসনে বসানো হবে। তার মাথায় পরানো হবে উজ্জ্বল মুকুট। তারপর তাকে সসম্মানে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। কিন্তু স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখার আগেই তাকে চলে যেতে হলো পরপারে। আবিদের হিফজ শেষ হতে যখন আর তিন মাস বাকি, তখনই তিনি মারা যান। এখন মা আর দুই ভাইবোন নিয়ে তাদের সংসার।
বাবা মারা যাওয়ার পর আবিদরা অনেকটা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। পরিবারের বড় ছেলে সে। এ অবস্থায় পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই মাকে বলেছিল, আবিদকে কোনো কাজে লাগিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি তাদের এসব কথা কানে তোলেননি। স্বামীর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের ইচ্ছা করেন। তাই হিফজ শেষ করার পর আবিদকে ভর্তি করে দেন কিতাব বিভাগে। নিজে কাপড় সেলাই করে সংসার চালাতে থাকেন। স্বামীর মতো স্বপ্ন দেখেন—তিনি হবেন একজন হাফেজ-আলেমের মা! আবিদ হবে তাদের গর্ব। তাই শেষরাতে জায়নামাজে বসে সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
২.
মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে সুমধুর আজান। আবিদের ঘুম ভেঙে যায়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। ওজু করে এসে মাকে জাগিয়ে দেয়। ছোট ভাই আরিফকেও ডেকে তোলে। ওর বয়স এবার সাতে পড়েছে। এখন থেকে নামাজের তালিম দিতে হবে। তাই ওকে নিয়ে রওনা হয় মসজিদের দিকে। নামাজ শেষ করে কবরস্থানে যায়। বাবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সুরা ইয়াসিন পড়ে তার জন্য রহমতের দোয়া করে। এসময় বাবাকে তাদের খুব মনে পড়ে। আবিদ নিজেকে সামলে নেয়। আরিফের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়।
বাড়িতে এসে দেখে মা সকালের খাবার রান্না করছেন। আবিদ মাকে সহায়তা করতে যায়। মা বলেন, ‘এসব আমি একাই পারব। তুমি আরিফ-সুমাইয়াকে একটু পড়াও। আজকে ওদের মক্তব বন্ধ!’
মায়ের কথামতো আবিদ দুই ভাইবোনকে পড়াতে বসে। আরিফ আর সুমাইয়া মনের আনন্দে পড়তে থাকে। পড়ানোর ফাঁকে আবিদ ওদেরকে গুলিস্তা থেকে শেখ সাদির একটি গল্প শোনায়। এতে ওরা আরও খুশি হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রান্না শেষ হয়ে আসে। মা সবাইকে খেতে ডাকেন। আলু ভর্তা, হেলেঞ্চা শাক আর ডাল। তা দিয়ে পেট ভরে খেয়ে আবিদ মাদরাসার দিকে রওনা হয়।
প্রতিদিনের পথ ধরে হাঁটতে থাকে আবিদ। মাটির সড়ক ছেড়ে পাকা রাস্তায় উঠবে, তখনই দেখে বিপরীত দিক থেকে তার বয়সী একটি ছেলে এগিয়ে আসছে। আবিদ তাকে দেখে সালাম দেয়। ছেলেটি কাছে এসে সালামের জবাব দিয়ে হাসিমুখে বলে ওঠে, ‘আমার নাম হাসিব। আপনি কি দারুল উলুম মাদরাসায় পড়েন?’
আবিদ নিজের নাম বলে জানায়, ‘জি, আমি ওই মাদরাসার ছাত্র।’
‘কোন জামাতে পড়ছেন?’
‘নাহবেমির জামাতে।’
ছেলেটির এ প্রশ্নে আবিদের মনেও একটু কৌতূহল জাগে। তাই সে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি কি এই মাদরাসায় নতুন ভর্তি হয়েছেন?’
হাসিব মাথা নেড়ে জানায়, ‘জি, গতকাল নাহবেমির জামাতে ভর্তি হয়েছি। আপনার ক্লাসমেট।’
শুনে আবিদ হাসিমুখে বলে ওঠে, ‘তাহলে তো ভালোই হলো!’
পাকা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে দুজনে। কথায় কথায় হাসিব জানায়—সে শহরের এক মাদরাসায় পড়ত। মাঝখানে দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিল। ডাক্তার তাকে বলেছে আবহাওয়া বদল করতে। তাই এ মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে। এখানে ফুফুর বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে। এভাবে আলাপ করতে করতে তারা মাদরাসায় চলে আসে। দুজনে একসাথে গিয়ে ক্লাসে বসে। মনের অজান্তেই তারা হয়ে ওঠে অন্তরঙ্গ বন্ধু।
৩.
প্রতিদিন জোহরের পর মাদরাসায় খতমে অজিফা হয়। আজকে হচ্ছে জালালি খতম। ছাত্ররা নামাজের কাতার ঠিক রেখে বসে অজিফা পড়ছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অজিফা পড়া হলে খতম শেষ হলো। এবার মুনাজাত হবে। মুহতামিম সাহেব মুনাজাত শুরুর আগে সব ছাত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন—
‘প্রিয় ছাত্ররা! কয়েকদিন আগে আমার দেশ পত্রিকায় একটা নিউজ ছাপা হয়েছে। দেশের একদল নাস্তিক ব্লগার ইসলাম ধর্ম এবং আল্লাহ, রাসুল, কুরআন, নামাজ এসব নিয়ে চরম বেয়াদবিপূর্ণ কটূক্তি করেছে। নবিজির শানে তারা যেসব কথা বলেছে, সেগুলো হয়তো কোনো কাফেরও বলতে সাহস করবে না। এজন্য আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। আল্লাহই তাদের উচিত বিচার করবেন!’
একটু থেমে হুজুর বলতে লাগলেন—
‘এখন আমাদের উচিত এহেন গর্হিত কাজের প্রতিবাদ করা। এর মধ্যে আমাদের মুরব্বি আল্লামা আহমদ শফি সাহেব হেফাজতে ইসলাম থেকে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ নিয়ে সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি পেশ করেছেন। সেইসাথে আগামী ৬ এপ্রিল লংমার্চের ডাক দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা হজরতকে নেক হায়াত দান করুন। তিনি যেন এই বাতিলকে প্রতিহত করতে পারেন, সেই তাওফিক দিন!’
সব ছাত্র বলে উঠল—‘আমিন!’
তারপর হুজুর মুনাজাত শুরু করলেন। কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে আরজি জানালেন—
‘মাবুদ, তারা তোমার নবির শানে বেয়াদবি করেছে, দীনের ওপর আঘাত করেছে। যদি তাদের ভাগ্যে হেদায়াত থাকে, তাদেরকে হেদায়াত দাও; আর নয়তো তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দাও। মাবুদ গো, আমাদের শক্তি দাও, যেন এই বাতিলকে প্রতিহত করতে পারি। আমাদের এই দোয়া কবুল করো মালিক!’
মসজিদ থেকে সব ছাত্র ক্লাসরুমে এল। এখন শুরু হবে তাকরার। আবিদ আর হাসিব একই গ্রুপে তাকরার করে। দুজনে কিতাবাদি নিয়ে বসেছে। কিন্তু আবিদ কেমন মনমরা হয়ে আছে। তা দেখে হাসিব জিজ্ঞেস করল, ‘আবিদ, কী হয়েছে তোমার? মনটন খারাপ নাকি?’
আবিদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মুহতামিম সাহেবের মুখ থেকে এসব খবর শুনে খুবই খারাপ লাগছে। নাস্তিকগুলো আমাদের নবিজিকে নিয়ে না জানি কীসব বেয়াদবি করেছে!’
‘তুমি কি আমার দেশের নিউজটা পড়োনি?’
আবিদ মাথা নাড়ল। হাসিব বলল, ‘আমার কাছে আছে। আজকে যাওয়ার সময় তোমাকে পড়তে দিব!’
‘আচ্ছা, বেশ। এবার এসো তাকরার শুরু করি।’
৪.
মাদরাসা ছুটি হলো বিকেল পাঁচটায়। আবিদ হাসিবের সাথে তার ফুফুর বাড়িতে গেল। হাসিব পত্রিকার কার্টিংটি নিয়ে তাড়া দিল, ‘চলো খেলার মাঠে যাই। সেখানে বসে এটা নিয়ে আলোচনা করব।’
পত্রিকাটি দেখে আবিদের আর তর সইল না। সে হাঁটতে হাঁটতে পড়তে শুরু করল। পুরো নিউজটি পড়ে তার চোখদুটো অশ্রুতে ভরে উঠল, ভেতরে জ্বলে উঠল দ্রোহের আগুন। শান্তশিষ্ট আবিদ হঠাৎ করেই কেমন আগুনের গোলা হয়ে গেল। তার চোখমুখ ঠিকরে বেরোতে লাগল দ্রোহের স্ফুলিঙ্গ।
তারা গিয়ে খেলার মাঠের একপাশে বসল। আবিদের মনের অবস্থা আঁচ করে হাসিব বলল, ‘বন্ধু, তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। আমারও এমন হয়েছিল। আর এখন এটা শুধু তোমার-আমার না, সারা দেশের প্রতিটি মুসলমানেরই মনের অবস্থা।’
আবিদ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল, ‘নাস্তিক ব্লগাররা নবির শানে যে বেয়াদবি করেছে, এর জন্য কি তাদের কোনো বিচার হবে না?’
হাসিব মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, ইসলামি বিধানমতে শাতেমে রাসুলের শাস্তিই তাদের প্রাপ্য।’
আবিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, ‘হায়, যদি আমাদের হাত দিয়ে প্রতিহত করার শক্তি থাকত!’
হাসিব কথাটি টেনে নিয়ে বলল, ‘হাত দিয়ে প্রতিহত করার শক্তি যেহেতু নেই, আমরা মুখ দিয়ে করব। শোনোনি মুহতামিম সাহেব যে বললেন, হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে শরিক হওয়া আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। সেখানে অংশগ্রহণ করে আমরা এর প্রতিবাদ করব, শাস্তির দাবি জানাব।’
হাসিবের কথায় আবিদ উদ্দীপ্ত হয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ বন্ধু, আমি এ লংমার্চে যাব। নবির ইজ্জত রক্ষার মিছিলে শামিল হব। ইনশাল্লাহ!’
হাসিবও বলে উঠল, ‘ইনশাল্লাহ বন্ধু, হেফাজতের এ তপ্ত আহ্বানে আমিও সাড়া দিব তোমার সাথে!’
ততক্ষণে খেলার মাঠজুড়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। খেলার পাঠ চুকিয়ে ছেলেপুলেরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে। এখনই ভেসে আসবে মাগরিবের আজান। আবিদ আর হাসিব দুই বন্ধু উঠে মাদরাসার দিকে রওনা হলো। যেতে যেতে হেফাজতের তপ্ত আহ্বানে সাড়া দেওয়ার উদ্দীপনায় তারা গেয়ে উঠল—
আসুক না যত বাধা, যত ঝড়-সাইক্লোন
রাসুলের পথে মোরা চলবই
এ জীবন বাজি রেখে জয়ের নিশান মোরা
বাংলার আকাশে উড়াবই!
চার.
লংমার্চ শুরু আগের দিনটি ছিল শুক্রবার। একে তো জুমার দিন, এর ওপরে সরকারি ছুটি। কিন্তু সেদিন সারাদেশে সরকারিভাবে হরতাল ডাকা হয়—বাংলাদেশের ইতিহাসে যা কখনোই হয়নি। সড়কপথ, রেলপথে সব ধরনের গাড়ি চলাচলে জারি হয় কঠোর নিষেধাজ্ঞা। নদীপথেও নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোটা দেশ থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় ঢাকাকে। এতে করে যারা লংমার্চে অংশগ্রহণ করতে রওনা হয়, তাদের অনেককেই রাস্তায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কাছাকাছি গিয়েও তারা ঢাকায় ঢুকতে পারেনি। প্রতিটি প্রবেশপথেই সরকারি বাহিনী তাদের আটকে দেয়। তবুও ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা হেফাজতের লংমার্চে অংশগ্রহণ করতে বাধভাঙা জোয়ারের মতো ছুটে যায়।
৬ এপ্রিলের আগে-পরের সময়টায় আমি ছিলাম বাড়িতে। প্রচণ্ড ইচ্ছা ছিল, লংমার্চে শরিক হতে ঢাকা যাব। মাদরাসা থেকে একটি কাফেলা যাবে শুনলাম। কিন্তু দাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়িতে চলে আসতে হলো। যে কারণে বাড়িতেই থাকতে হলো অনেক দিন। এ সময়টায় মনে হচ্ছিল, গ্রাম থেকে হয়তো ঢাকার চলমান আন্দোলনের কোনো খবরাখবর পাব না। কিন্তু দেখি, হেফাজতের আলোড়নের বাতাস আমাদের ভাটি এলাকার অজপাড়াগাঁয়েও জোরেশোরে বইতে থাকে। গ্রামের মাদরাসার হুজুররা নিয়মিত পত্রিকা আনেন। সকালের পত্রিকা পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যায়; কোনোদিন আগের দিনের পত্রিকা পৌঁছে পরের দিনে। আমি গিয়ে সেখানে পত্রিকা পড়ি। বাজারের চা-স্টলগুলোর টিভিতে সারাদিনই চলত বাংলা সিনেমা। এ ইস্যুতে সবাই সিনেমা দেখা ছেড়ে নিয়মিত খবর দেখতে লাগল।
লংমার্চের দিন বাজারের প্রতিটি চা-স্টলে উপচে পড়া ভিড় লেগে যায়। ছেলেবুড়ো, হিন্দু-মুসলমান সকলেই ভিড় জমায়। আমিও গিয়ে ভিড়ে যাই তাদের দলে। দেখি বিভিন্ন চ্যানেল থেকে খবর প্রচারিত হচ্ছে। সরকারি বাধা-নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও বিশাল এক জমায়েত হয়ে গেছে। ঢাকার বিভিন্ন পথে হেঁটে হেঁটে প্রতিবাদ মিছিল করছে তারা। শাপলা চত্বরে জড়ো হয়েছে অনেকেই। অনেকেই আবার ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশপথে আটকে আছে। তাদেরকে দীর্ঘ সফরে ক্লান্তশ্রান্ত দেখালেও প্রতিবাদী শ্লোগান দেওয়ার সময় দারুণ উজ্জীবিত মনে হচ্ছে। এভাবেই বিফল ও বানচাল করার শত চেষ্টার পরও সফলভাবে পালিত হয় হেফাজতের লংমার্চ। সেইসাথে ঘোষণা আসে, সরকার ১৩ দফার দাবি মেনে না দিলে আগামী ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে।
হেফাজতের ঢাকা অবরোধের ঘোষণায় সারাদেশের ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা আরও উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আহমদ শফির নির্দেশনাকে সবাই হৃদয় দিয়ে বরণ করে নেয়। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে হেফাজতে ইসলামের সাথে মিশে যায়। সরকারের প্রধান বিরোধী দলও হেফাজতের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চ সরকারি মদদপুষ্টতায় তাদের কথিক চেতনার স্রোতকে ঘুরিয়ে দেয় হেফাজতের বিরোধিতায়। বেশ কিছু বাম রাজনৈতিক দল তাদের সাথে গলা মেলায়। কিন্তু হেফাজতের দেশব্যাপী আলোড়নের ভেতরে তাদের এসব তর্জন-গর্জন ভাঙা টেপে ফিতেকাটা ক্যাসেট হয়ে শাহবাগ মোড়েই বাজতে থাকে।
এবার আমাদের মেধামননে জেঁকে বসে ৫ মে তারিখটি। এ নিয়ে কথাবার্তা বলে দারুণ উদ্দীপনা বোধ করি। সবাই ভেতরে ভেতরে এ আকাঙ্ক্ষা লালন করি, হেফাজতের যেকোনো কাজে কোনোভাবে যদি শরিক থাকতে পারতাম! এর মধ্যে একদিন পেয়ে যাই ১৩ দফা দাবির ব্যাখ্যা সম্বলিত লিফলেটটি। এক শুক্রবারে কয়েকজন বড় ভাই আসেন এটি নিয়ে। আমাদের মাদরাসায় কিছু লিফলেট দিয়ে বলে যান, জুমার পর এগুলো মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে দিতে। সহপাঠীরা দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। আমাকে যেতে বলা হয় উপজেলা মসজিদে। আমি সেখানে গিয়ে জুমার নামাজ পড়ি। নামাজের পর শুরু করি লিফলেট বিতরণ। লোকজন বের হতে থাকে আর আমি সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিতে থাকি একটি করে লিফলেট। এভাবে সব লিফলেট বিতরণ করে আনন্দিত মনে ফিরে আসি মাদরাসায়।
মাদরাসায় আসার পর জানতে পারি, যারা লিফলেট বিতরণ করতে গিয়েছিল, তাদের কয়েকজনের ওপরে হামলা হয়েছে। স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা, যিনি সরকার দলের উপজেলা সংগঠনের সভাপতি, তার চেলারা এটা করেছে। সাথে সাথে মনে পড়ে, এই সভাপতিকে আমি নিজ হাতে একটি লিফলেট দিয়েছি। তখন লোকটি আমার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়েছিল। আমাকে পুঁচকে ছেলে ভেবেই হয়তো কিছু বলেনি। সহপাঠীরা এটা শুনে আমাকে সাবধানে থাকতে বলে। কিছুদিনের মধ্যে এটা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়—হেফাজতের পক্ষ হয়ে কথা বলা কিংবা এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো প্রতিটি লোককেই সরকার দলীয় প্রভাবশালী নেতা ও তাদের চেলাদের হাতে নিগ্রহের শিকার হতে হয়। এমনকি যেসব মসজিদ-মাদরাসায় তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা ছিল, সেখানেও কঠোরভাবে বলে দেওয়া হয়—কোনো ছাত্র-শিক্ষক বা কর্মচারী যেন হেফাজতের ডাকে ঢাকায় না যায়!
পাঁচ.
দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে ৫ মে তারিখটি। অদম্য ইচ্ছা থাকার পর মাদরাসার নিয়মের বেড়াজালে পড়ে ঢাকায় যেতে পারি না। মাদরাসা-কমিটির বেশ কয়েকজন লোক সরকার দলের নেতা ও সমর্থক। তারাই মুহতামিম সাহেবকে বাধ্য করে ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারী সবাইকে ঢাকা যাওয়া থেকে আটকে রাখতে। এমনকি ৫ মের দিন মাদরাসার গেইটও তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ঢাকায় যেতে না পারলেও কেউ কেউ লুকিয়ে চলে যায় আত্মীয়ের বাসায় কিংবা লজিংবাড়িতে। অনেক টিভি চ্যানেল থেকে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির লাইভ চলতে থাকে। চালাক-চতুর সহপাঠীদের অনেকেই চলে যায় এ লাইভ দেখতে। কিন্তু আমি যাওয়ার মতো সাহস করতে পারি না। যে কারণে ৫ মের সারাটা দিন মাদরাসায় আবদ্ধ থেকে প্রচণ্ড অস্থিরতায় পার করি।
পরদিন ভোরবেলায় পাই এক হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ। মতিঝিল শাপলা চত্বরে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটা ভয়াল ট্র্যাজেডি। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলাম অবমানননার দায়ে কতিপয় নাস্তিক-মুরতাদের বিচারের দাবি জানাতে গিয়ে সরকার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। হ্যাঁ, অসংখ্য মানুষই বটে! কারণ এর পরের গোটা একটা দশক চলে গেলেও শাপলা-শহিদদের সঠিক সংখ্যাটা কেউই জানতে পারে না! আর যেখানে নিহতের পরিসংখ্যানই জানা হয় না, সেখানে বিচার দাবির কথাটা উঠবে কীভাবে? তবুও যেসব মুখ এ নিয়ে কথা বলে এবং যে কণ্ঠস্বরগুলো শাপলা-শহিদদের বিচারের দাবিতে উচ্চকিত হয়, তাদেরকে করে দেওয়া হয় চিরকালের মতো স্তব্ধ!
এদিনের ঘটনার পর থেকে থেমে যায় আমার কলমের গতি। ডায়েরির পাতাগুলোও দিনের পর দিন সাদা হয়ে থাকে। বেদনাদগ্ধ হৃদয়ের কথামালা ডায়েরির পাতায় আর জমা করে রাখতে ইচ্ছা হয় না। যে কারণে শাপলা-ট্র্যাজেডির পরবর্তী সময়টায় আমি কিছু লিখতে পারিনি। বিধুর মন এ বিষয়ে কিছু ভাবতে গেলেই মুষড়ে পড়ত। তবে এর ঠিক পরের বছর, যখন এ বিয়োগান্ত ঘটনার এক বছর পূরণ হয়, সেদিন একটি শোকগাথা লিখি। এরপরে আরও কয়েকটি কবিতা লেখা হয়। তবে এ শোকগাথায় ঠিকভাবে প্রকাশ পায় আমার বেদনাদগ্ধ কিশোর হৃদয়ের অভিব্যক্তি—
বিধুর রোমন্থন
হারিয়ে গেছো তোমরা যারা ভয়াল কালো রাতে
সেই তোমাদের খুঁজে ফিরি আজও নিত্য প্রাতে!
তোমরা যারা জীবন দিলে নবির মহব্বতে
কালো রাতে আলোর পথে নামলে রাজপথে!
হারিয়ে গেলে কই তোমরা, কোন সে অজানাতে?
সেই তোমাদের খুঁজে ফিরি আজও নিত্য প্রাতে!
তোমরা যারা নবির আশেক, সরলমনা মানুষ
একটি ডাকে উঠলে জেগে সাইফুল্লাহর রোষ!
নিজেদেরকে করলে অমর কাম্য শাহাদাতে
সেই তোমাদের খুঁজে ফিরি আজও নিত্য প্রাতে!
ওই হায়েনা করল কী হায়; ভাই তোমাদের সাথে
কত নির্মম এই ট্র্যাজেডি রচিল অতর্কিতে!
আসবে কি ফের মোদের মাঝে শাপলা সমবেতে?
সেই তোমাদের খুঁজে ফিরি আজও নিত্য প্রাতে!
এরপর থেকে প্রতি বছরই যখন ৫ মে দিনটি আসে, সেই ট্র্যাজেডির কথা মনে করে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কেবলই মনে পড়ে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাওয়া ভাইদের কথা—যারা নবির ইজ্জর রক্ষার মিছিলের শামিল হয়ে শহিদ হয়েছেন আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন হাজারো মহাকাব্য রচনার উপাত্ত। আমরা যারা মাদরাসাপড়ুয়া কলমসৈনিক, তাদের কাঁধে দিয়ে গেছেন শাপলা-ট্র্যাজেডির সত্য ইতিহাস রচনার গুরু দায়িত্ব। তাই এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে আমার যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকি! সবশেষে শাপলা-শহিদদের স্মরণে আওড়াই এ পঙক্তিটি—
হে শহিদি কাফেলা ঘুমাও নিঝুম
তুবাকুম! তুবাকুম! সুম্মা তুবাকুম!