কানের গোড়ায় করতালের বিকট ঝনঝন শব্দে আলতাফের ঘুম ভেঙে গেল। খুদকুঁড়োর নিচে জাগ দেওয়া কাঁচা ফলটির মতো ঘুম তার। একবার চোখ বুজলে পেকে টসটসে হওয়ার আগ পর্যন্ত সজাগের নাম নেই। সেই ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎই।
খালি চৌকির উপর একটি পাতলা কাঁথা বিছিয়ে শুয়েছিল সে। ঘুম ভেঙে সটান শুয়ে রইল সেখানে। কল্কের টানটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল কি-না, কতক্ষণ ঘুমিয়েছে হুঁশ নেই। এখন হুঁশ ফিরলেও রেশ কাটেনি। কেমন একটা ঘুমজড়ানো ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। ঝনঝন শব্দটা ঝংকার করছে কানের ভেতর। এটাকে সে কল্পনা করছে হিন্দুপাড়ার কীর্তনের বাজনা বলে। কিন্তু ঢাকঢোলহীন শুধু করতালের শব্দ তো এমন নয়! পরক্ষণেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ফাল্গুনী-রাতের যাত্রাগানের আসরটি। নর্তকী মর্জিনা, যার পাকা আতা ফলের মতো বক্ষোজের স্ফীতি আর মিষ্টি কুমড়োর মতো নিতম্বের দোলন দেখে আনচান করে উঠেছিল পাঁচ গাঁয়ের ছেলেবুড়ো সকলের মন, এ যেন তারই ঘুঙুরের শব্দ । ঝুমুর ঝুমুর ছন্দে দেহবল্লরি দুলিয়ে মর্জিনা এগিয়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ তবলার পিঠে তবলচির শেষ চাটিটির মতো ধম করে আরেকটি শব্দ হলো কানের গোড়ায়। এবার তার সম্বিৎ ফিরল—এটা কোনো স্বপ্ন নয়, বাস্তব।
আলতাফ শুয়েছিল চালাঘরের চৌকিতে, পাশে একটি কাঠের আলমারি। প্রায়ই সেখানে খাবারের লোভে বিড়াল হামলা করে। কিন্তু নচ্ছার বিড়াল বুঝে না—সে একজন হাভাতে মানুষ, এর ওপর প্রচণ্ড কুঁড়ে। কামাই-রোজগারের কোনো বালাই নেই। একবেলা রান্না করে চালিয়ে দেয় সারাদিন। প্রায়দিনই চুলোয় ডেগ চড়ে না। বেশি খিদে পেলে পাড়া পড়শি কারো ঘরে গিয়ে চেয়েমেগে একথালা খেয়ে নেয়। পাড়ার লোকেরা তাকে দিয়ে বিনা মজুরিতে কাজকাম করাতে আর বউ-ঝিরা ফুট-ফরমাশ খাটাতে পারে বলে একবেলা খাওয়াতে কেউ আপত্তি করে না। তার বেশিরভাগ সময় কাটে হাফিজের চা-স্টলে। পাড়াগাঁয়ের চা-স্টলগুলো পৃথিবীর সেরা সংসদ, সেখানে আকাশ-পাতাল সমস্ত বিষয়ের ওপর মুহূর্তের মধ্যেই আইন পাশ হয়ে যায়। মাতব্বরদের চায়ের কাপে ঝড় তোলা সমাজ-বিশ্লেষণ শুনে আর গরম গরম বাংলা সিনেমা দেখে বেশ কেটে যায় আলতাফের দিন।
প্রতিদিনের চা-চুরুট হাফিজ তাকে মাগনাতে দেয়। বিনিময়ে গাং থেকে দু-চার কলসি পানি আর দোকানে দোকানে চা-ডেলিভারির কাজটা করে দিতে হয়। এতে করে দিনশেষে বিশ-পঞ্চাশ টাকা মজুরি পায় আর এর পুরোটা ঢেলে দেয় গাঁজার কল্কেতে। বাজারপাড়ার আবুল, শরিফ আর হিন্দুপাড়ার নিরঞ্জন তার কল্কের সাথি। তাদের নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় চলে যায় কাছারিবাড়ির পেছনে। সেখানে মাঝরাত পর্যন্ত মনের সুখে কল্কে টানে আর চালাঘরে মরার মতো পড়ে পড়ে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়।
বিয়ের আগে এভাবে চলছিল আলতাফের জীবন। বাউণ্ডুলের মতো লক্ষ্য ও সঞ্চয় না থাকায় তার মনে কোনো ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল না; কেবলই ছিল খেয়ালখুশি মতো চলতে পারার আনন্দ। লুৎফার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সেই জীবনের লাগাম টেনে ধরতে হলো। ধীরে ধীরে সে ছন্নছাড়া থেকে সাংসারিক খাপের মধ্যে এসে পড়ল। তখন পাড়ার লোকেরা এবং আলতাফ নিজেও মনে করেছিল, তার জীবনের পালে হাওয়া লেগেছে, এবার ঘর-সংসার হবে।
ছোট চালাঘরটিতে সুখী চড়ুইয়ের মতো একটি সুন্দর দাম্পত্য জীবন শুরু করল তারা। বছর না ঘুরতেই সেই ঘর আলো করে জন্ম নিল একটি ফুটফুটে মেয়ে। আলতাফ ও লুৎফা ভালোবেসে মেয়ের নাম রাখল দুলালি। সেসময় পরিবার-পরিকল্পনা নিয়ে তারা একটি গ্রাম্য-সমিতির সঙ্গে যুক্ত হলো। এক বছরে বেশ ভালো টাকা-পয়সা জমিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন সমিতির প্রধান শাহীন আলম সমস্ত সঞ্চয় নিয়ে হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। বিষাদ নেমে এল আলতাফ-লুৎফার মতো দরিদ্র দম্পতির পরিবারে। এ নিয়ে দুজন কয়েকদিন বিমর্ষ হয়ে রইল। ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে লাগল সাংসারিক টানাপোড়েন। আলতাফকে পেয়ে বসল সেই পুরোনো অভ্যেস—কুঁড়েমি আর কল্কে টানা। ধারকর্জ করে চলতে চলতে লুৎফা এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠল। স্বামীর সংসার বিমুখতা লক্ষ্য করে তার মেজাজ হয়ে গেল খিটখিটে। প্রায়ই তাদের মধ্যে মনোমালিন্য ও কথা কাটাকাটি হতো। এটাই হয়ে দাঁড়াল সংসার ভাঙার কারণ।
একদিন ঘর-সংসার তুচ্ছ করে তিন বছরের মেয়ে দুলালিকে ফেলে লুৎফা চলে গেল বাপের বাড়ি, সেখান থেকে ঢাকা। আলতাফ ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল, লুৎফা হয়তো দুলালির টানে ফিরে আসবে। কিন্তু এক বছরের মাথায় খবর পেল, লুৎফা গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে এক রিকশাওয়ালার সঙ্গে নতুন করে সংসার শুরু করেছে। আলতাফ ফিরে গেল সেই আগের জীবনে। এখন সে গাঁজার কল্কেতে দম দেয় ঠিকই, তবে দুলালির টানে ঘরে ফিরে আসে। একদিন কাজ করে, তিনদিন শুয়ে-বসে থাকে আর তিনদিন চেয়েমেগে দিন গুজরান করে।
হাতের তালুতে চোখ কচলে, বোয়াল মাছের মতো মুখ খুলে হাই তুলতে তুলতে আলতাফ এবার উঠে বসল। শরীর টানা দিতে দিতে তাকাল আলমারির দিকে। কপাট দুটো হাঙরের হাঁ-এর মতো মেলানো। মাটিতে পড়ে আছে একগাদা থালা-বাসন, ওষুধের বোতল আর দুলালির খেলনাপাতির সঙ্গে পান্তা ভাতের বাটিটি। দেখেই তার চোখ ছানাবড়া, মেজাজ গেল বিগড়ে। মনে মনে সে এসবের জন্য দায়ী করল ছোঁচা বিড়ালটিকে। দাঁত কিড়মিড় করে গাল দিয়ে উঠল—‘চুতমাৎ বিলাই কামডা কিতা করল, হেহ্! খাড়অ, এইডেরে আজ্গো ধরতাল্লে কুদিন দেলাম!’
শরীরভরতি রাগ নিয়ে চৌকি থেকে নিচে নামল। পরনের লুঙ্গি ঠিক করতে করতে তাকাল মাটিতে পড়ে থাকা এলোপাতাড়ি জিনিসগুলোর দিকে। মনে মনে আবারও গাল দিয়ে উঠল ছোঁচা বিড়ালের চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে। নত হয়ে ভাতের বাটিটি তুলতে যাবে, তখনই তার দৃষ্টি পড়ল চৌকির নিচে; সেখানে জবুথবু হয়ে বসে আছে দুলালি। দেখেই আলতাফের মেজাজ গরম হয়ে গেল—বিড়াল নয়, এসব দুলালিরই কাজ। আলমারির ওপর থেকে খেলনাপাতি নামাতে গিয়ে ঘটিয়েছে এই কাণ্ড।
অসময়ে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আলতাফের নেশার ঘোর এখনো কাটেনি। তার মেজাজ এবার তিরিক্ষি হয়ে উঠল। ক্ষুব্ধ গলায় মেয়েকে গাল দিয়ে বসল—‘চু…রানির ছেরি, তুই কামডা কিতা করছস, হেহ্! ..লমেরার জিনিশের লাইগ্যে ঘরটারে আমার মারা লাগায়েল্ছস্! খাড়অ ছেরি, তরে আজ্গো পিডায়া বাপ ডাহায়াম!’
বলে বাঁশের কঞ্চি আনতে ছুটে গেল ঘরের কোণায়। বাপের এই রুদ্রমূর্তি দেখে ভীষণ ভয় পেল দুলালি। ফাঁকতালে চৌকির নিচ থেকে বেরিয়ে ছুট দিল ঘরের বাইরে।
ক্ষুধার্ত বাঘের থাবা থেকে হরিণশাবক ফসকে গেলে বাঘ যেরকম বুভুক্ষু পাষাণ হয়ে ওঠে, দুলালিকে হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে দেখে আলতাফও সেরকম উন্মুক্ত হয়ে উঠল। নেশার ঘোরে সে এখন উন্মাতাল। কঞ্চি হাতে ছুট দিল মেয়ের পেছনে বাপকে ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে দুলালি প্রাণের ভয়ে দিল ভোঁ দৌড়।
দৌড়াতে দৌড়াতে স্কুলঘরের গলিতে ঢুকে ধাক্কা খেয়ে বসল সফিরুদ্দিন মেম্বরের সঙ্গে। ধাক্কার চোটে ব্যথা পেয়ে শুরু করল কান্না। সফিরুদ্দিন মেম্বর পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলেন। রাগে আগুন হয়ে তাকালেন সামনের দিকে। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া একটি ছোট মেয়েকে কাঁদতে দেখে তিনি হতভম্ব। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন মেয়েটির দিকে। ধাতস্থ হয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন—‘অই ছেরি, কিতা অইছে তর? বহন বাছুরের মতন এম্নে দৌড়তাছস্ কেরে?’
দুলালি কিছু না বলে কাঁদতে থাকল। দেখে সফিরুদ্দিন মেম্বর ধাতানি দিলেন—‘কিরে ছেরি, ফ্যাঙ্গাইতাছস্ কেরে এম্নে? তরে আমি মারছি-টারছি না কিতা?’
দুলালির কান্না থামে না। সফিরুদ্দিন মেম্বর আবারও ধাতানি দিলেন—‘অই ছেরি, রাও করস্ না কেরে? তুই কার ঘরের? তর বাফের নাম কিতা?’
কান্নার চোটে দুলালির হেঁচকি উঠছে। সফিরুদ্দিন মেম্বরের ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন— ‘দুরু যা হেডার ছেরি, বাছুরের মতন বেমড়াইতেই আছস্ খালি। অই আমারে রাস্তা দে, আমি যাই, তুই এল্লা ফ্যাঙ্গাইতে তাকগা!’
বলে চলে যেতে উদ্যত হলেন।
শুক্রবারের দিন, জুমার আজান পড়েছে একটু আগে। তিনি মসজিদে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এই উটকো ঝামেলায় পড়ে তার মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু গলির মুখে যেতেই আলতাফের মুখোমুখি হলেন। তাকে কঞ্চি হাতে তেড়েমেড়ে ছুটে আসতে দেখে বুঝতে পারলেন ঘটনা। আচ্ছামতো ধাতানি দিলেন—‘কিরে হালা গাইঞ্জাখোর, তুই এই ছেরিডেরে দৌড়াইতাছস্ কেরে? হালা কমিনের ঘরের কমিন, ..লমেরা খাইয়া দাতি লাইগ্যে ফইড়ে তাহস্, আরেকবালি ফুলাফানেরে শাসন করছ। কিতা চাইছস্ তুই?’
মেম্বরের ধাতানি খেয়ে আলতাফ অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার নেশার ঘোর কেটে গেছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য মনে মনে সে লজ্জিত। সফিরুদ্দিন মেম্বরও ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। কিছুটা ঝাঁঝালো গলায় তাড়া দিলেন—‘যা, ছেরিরে লইয়া বাড়িত যা। শুক্কুরবারের দিন, বুর-গুসুল ফাইড়ে আল্লার নাম লইয়া মসজিদে যা, নমাজ-কলাম ফড়গা যাইয়া!’
সফিরুদ্দিন মেম্বর মসজিদের উদ্দেশে হাঁটা দিলেন। আলতাফ হ্যাঁ-বোধক মাথা নেড়ে দুলালিকে কাছে ডাকলেন—‘দুলি, আ বাড়িত যাই!’
দুলালি বাপের নেশা কাটার ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। তাই মুখভার করে মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানাল। মেয়ের অভিমান বুঝতে পেয়ে আলতাফ হাসি হাসি মুখ করে মিষ্টি গলায় ডাক দিল—‘মায়া না ভালা, আও, আব্বা তোমারে শইলডে মরায়া বুর ফাড়ায়া দেই গা। বাদে আব্বা জুম্মাত্ যায়াম, তোমার লাইগ্যে শিন্নি আনাম্নে। আও মায়া!’
মিষ্টি কথার টানে দুলালি ছুটে এসে বাপের কোমরে ধরল। আলতাফ এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নিল মেয়েকে। বাপ যেন টাট্টু ঘোড়া, দুলালি সেই আন্দাজে লাগাম টানার মতো করে বাপের মাথার চুল ধরে টানছে আর আনন্দ ঝলমলে মুখে ‘হইশ্ ঘোড়া, হইশ্!’ শব্দ করছে। পৃথিবীর সব বাবা সন্তানদের কাছে তাদের খেলনার জিনিসের মতো। মেয়ের চুলের টান খেয়ে আলতাফ সানন্দে তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে পথ চলছে।