ফজরের পর হাঁটতে বেরোলাম। অনেক দিন হলো সকাল দেখা হয় না। ঘুমের ঘোরে গড়িয়ে যায় কর্মব্যস্ত দিনের সকাল। গভীর রাত করে ঘুমাতে যাওয়ার কুফল এটা। ঘুমের কাছে সকালকে সঁপে দেওয়ার পর থেকে ভুলে গেছি প্রাণোচ্ছল হাঁটাহাঁটির কথা। আজ সেই সুযোগটা মিলল। শীতের আমেজমাখা সকালের স্নিগ্ধতায় নিজেকে বিকশিত করতে পেরে বেশ প্রাণবন্ত লাগছে।
গুরুদয়াল মুক্তমঞ্চের ওয়াকওয়ে ধরে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। এবার নরসুন্দাপাড়ের ওয়াকওয়ে ধরে জামিয়ায় ফিরছি। ভেতরে প্রচণ্ড তাড়া কাজ করছে। ‘শাহনামা’র (ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর-এর পাক্ষিক ওয়েবম্যাগ) লেখাটি এখনো তৈরি হয়নি। রাকিব ভাইকে বলেছিলাম, রাতের মধ্যে লেখা তৈরি করে সকালবেলায় পাঠিয়ে দেব। শিরোনাম পাঠিয়ে দিয়েছি। শাহরিয়ার প্রচ্ছদ করে ফেলেছে কি না! এখন গিয়ে জলদি কাজটি সারতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত পা চালাচ্ছি।
গৌরাঙ্গবাজার মোড়ে এসে স্টেশন রোডে বাঁক নেব, দেখি কয়েকজন অটো ড্রাইভার জটলা বেঁধে হাসাহাসি করছে। তাদের সঙ্গে পথচারীদের অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ব্যাপারটা আমার কাছে কৌতূহলজনক লাগল। একটু দাঁড়ালাম। খেয়াল করে দেখলাম, পাঁচ-ছয়জন বালক বয়সী মাদরাসার ছাত্র—আন্দাজ করতে পারলাম, ওরা হিফজখানার ছাত্র হবে—দুই ‘পাগল’কে ঘিরে ‘চোটপাট’ দেখাচ্ছে। অটো ড্রাইভার আর পথচারীরা এটা দেখে হাসির খোরাক পাচ্ছে।
মাদরাসার ছাত্ররা পাগল মানুষের সঙ্গে এভাবে চোটপাট দেখাচ্ছে আর এটা নিয়ে সাধারণ মানুষজন হাসাহাসি করছে—বিষয়টা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগল। আমি যেহেতু ঘটনার পরম্পরায় যুক্ত ছিলাম না—মানে শুরু থেকে ঘটনাটি দেখিনি আর আগাগোড়া কিছু বুঝতেও পারছি না—তাই একটু দাঁড়িয়ে থেকে এটাকে ‘তামাশা’ মনে করে চলে যেতে চাইলাম।
মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিতেই পেছন থেকে শুনলাম লোকজন চিৎকার করছে। কান খাড়া করে ফিরে তাকালাম। দেখলাম, দুই পাগলের পুরুষ লোকটিকে মাদরাসার ছাত্রগুলো মিলে ‘গণপিটুনি’ দিচ্ছে আর বুড়ো মহিলাটি তাদের আশপাশে ছোটাছুটি করে চিল্লাচিল্লি করছে। এইটুকুন ছেলেপিলে, পূর্ণ বয়স্ক একটি লোককে ‘প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠি হাতে গণপিটুনি’ দিচ্ছে—ব্যাপারটা আমাকে নিদারুণ ক্ষুব্ধ করে তুলল। আমি ভেবে নিলাম, ওরা মাদরাসার প্রকৃত ছাত্র নয়; ছাত্র নামের ‘কলঙ্ক’।
ঘটনাটি নিজের জন্য লজ্জাজনক মনে করে সেখানে আর দাঁড়ালাম না। পাছে কোনো লোক আমাকে দেখে ইয়ার্কি করে না বসে—‘হুজুর, আফনের জাতি ভাইয়েরা তো ফাডায়া দিতাসে!’ এটা ভেবে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলাম। পেছন থেকে আরও কী সব ক্যাঁচাল-প্যাঁচাল ভেসে আসছিল, শুনলাম না কিছুই।
হোটেল ময়নামতিতে ঢুকলাম। ঘুমের কারণে প্রায় দিনই সকালের খাবার খাওয়া হয় না। প্রতিটি দিন শুরু হয় চোরা খিদে নিয়ে। ভাবলাম, আজ যেহেতু সকাল সকাল উঠে পড়েছি, তাহলে নাস্তাটা করে যাই। বেসিনে মুখ ধুয়ে টেবিলে বসলাম। ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর, কী খাইবেন?’ ভুনা খিচুড়ি খেতে মন চাইছিল। এটার অর্ডার দিলাম। খেতে খেতে শুনলাম, ওয়েটাররাও এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে আর হাসাহাসি করছে।
হঠাৎ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘হুজুর, ঘটনাডা দেখছেন নাকি?’ আমি একটু অবাক হওয়ার ভান করে তার দিকে তাকালাম। কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে?’ ওয়েটার বলতে লাগল, ‘এক হিরোইনখোর ওই বুড়া বেডির টাকা নিয়া গেসিন গা। মাদরাসার ছাত্ররা এইটা দেইখ্যা হেরে গিয়া ধরছে। ওই বেডির টাকা নিতে গিয়াই ছাত্ররা হিরোইনখোরটারে প্যাঁদানি দিছে।’
ওয়েটারের মুখে ঘটনার এই বিবরণ শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তার এই বিবরণ আমার কাছে অথেন্টিক মনে হলো। কারণ ঘটনার পরম্পরা তারা দেখেছে। এখানে বানোয়াট কিছু বলার অবকাশ নেই। এবার এর সাথে আমার নিরীক্ষণকে মেলালাম। দেখি আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমি যে লোকটিকে পাগল ভেবেছিলাম, সে একটা চোর ও মাদকাসক্ত আর যাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলাম—বালক বয়সী মাদরাসার ছাত্ররা—তারা প্রতিবাদী এবং অসহায়ের সহায়তাকারী।
পাঠক, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়—ওপরে উদ্ধার চিহ্ন দিয়ে কিছু শব্দকে আমি বিশেষায়িত করেছি। এবার আসুন ওই শব্দগুলোর ওপরে একটি নিরীক্ষণ চালানো যাক—
মাদরাসার ছাত্ররা যে লোকটিকে ঘিরে ধরেছিল এবং তার সাথে যে বুড়ো মহিলা ছিল, তাদের দুজনকে আমি অভিহিত করেছি ‘পাগল’ বলে। তাদের বেশভূষা দেখে এটা অনুমান করে নিয়েছি।
ছাত্রগুলো অল্প বয়সী বলে একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের সাথে যেভাবে কথাবার্তা বলছিল, সেটাকে আমি ধরে নিয়েছি ‘চোটপাট’ দেখানো আর এই ঘটনার পুরোটাকে ধরে নিয়েছি ‘তামাশা’ অর্থে—যা আমার মতো অনেকেই ধরে নিয়েছে এবং এটা মনে করেই সবাই হাসাহাসি করেছে।
ছাত্রগুলো লোকটিকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছিল আর একজনের হাতে ছিল একটি লাঠি—একে আমি আখ্যায়িত করেছি ‘লাঠি হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে গণপিটুনি’ বলে।
শেষে এই ঘটনার জন্য আমি ছাত্রদেরকে ‘দায়ী’ করেছি এবং একজন মাদরাসা ঘরানার লোক হিসেবে একে নিজের জন্য ‘লজ্জাজনক’ মনে করে স্থান ত্যাগ করে চলে এসেছি।
সেইসাথে আমি এটাও স্বীকার করেছি—এই ঘটনার আগাগোড়া আমি কিছুই দেখিনি আর আমার যা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এটা তাৎক্ষণিক দেখা থেকেই। সবশেষে এই ঘটনার একজন চাক্ষুষ দর্শনকারীর কাছ থেকে অথেন্টিক বিবরণ শুনে বুঝতে পেরেছি ঘটনার প্রকৃত বাস্তবতা।
এরকম একটি ঘটনা নিশ্চয় স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার মতো। কারণ এর টপিকটা খুব হট ও এক্সাইটিং। অন্তত ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত কেউ যদি একে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে এবং ফেসবুক বা ইউটিউবে আপলোড করে থাকে, তাহলে সেটি খুব ভিউ পাবে আর মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যাবে। এরপর এটা হয়ে যাবে এক ধরনের মাইন্ড গেম। কেউ একে পজেটিভ হিসেবে নেবে, কেউ নেবে নেগেটিভ হিসেবে। তখন হয়তো কেউ এই ঘটনার অথেন্টিক সোর্স খুঁজবে না!
কেউ যদি একে এই ক্যাপশনে লিখে পোস্ট করে—‘মাদরাসার ছাত্রদের হাতে গণধোলাইয়ের শিকার দুই পাগল’—তাহলে ভিডিও দেখে বোঝার উপায় নেই, ঘটনার প্রকৃত বাস্তবতা কী। কারণ এখানে ঘটনাটিকে এভাবেই প্রমোট ও হাইলাইট করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের কি উচিত না, স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল যেকোনো ঘটনারই ফ্যাক্ট চেক করা, প্রকৃত বাস্তবতা আর সত্যটা জানা?
হ্যাঁ, অবশ্যই উচিত। আমি মনে করি, আমাদের সমাজে এমন মনমানসিকতার লোকজন বেশি। তাই আসুন, আমরা স্যোশাল মিডিয়ায় প্রমোটেড আর ভাইরাল প্রতিটি ঘটনারই ফ্যাক্ট চেক করি। মিথ্যার ছড়াছড়ি থেকে বিরত থাকি। তিলকে আর তাল না বানাই!