মনে থাকুক মনকাঁটা
আমরা যে সাইয়েদ কুতুবকে চিনি, তিনি একজন অকুতোভয় মুজাহিদ, ইসলামি নবজাগরণ ও বৈপ্লবিক ভাবধারার আদর্শ ব্যক্তিত্ব। এর বাইরে তার আরেকটি পরিচয়—তিনি একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শিশুসাহিত্য, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে লেখালেখি করেছেন। কিন্তু কখনো সেভাবে তার এই রচনাগুলো পড়া হয়নি আমার। দারুল মাআরিফের মাকতাবায় তার ‘আন-নাকদুল আদাবি’ বইটি পাই। তখন এটি পড়া হয়। এরপরই আগ্রহ জাগে এ ধারার অন্য রচনাগুলো পড়তে। এই আগ্রহ থেকে পেয়ে যাই একটি উপন্যাস—‘আশওয়াক’। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। পরবর্তী সময়ে মিশরীয় লেখক শাবান ইউসুফ নিজের ভূমিকা দিয়ে এর একটি সংস্করণ বের করেন।
সাইয়েদ কুতুব সাহিত্যে আব্বাস মাহমুদ আক্কাদের ধারাকে অনুসরণ করতেন। এ ধারার একটি বৈশিষ্ট্য হলো—ধাঁচটা পুরোনো, কিন্তু শৈলীটা আধুনিক। ‘আশওয়াক’ উপন্যাসে তিনি এ ধারাটির নিজস্ব বয়ন ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে তার গদ্যটা এগিয়ে গেছে নামপুরুষের বয়ানে। বাক্যগুলো পাপড়ির মতো কোমল ও ছোট ছোট, কিন্তু ভাব ও আবেদনে তীব্র ও গভীর। সংলাপগুলো জীবনবোধের একেকটি আখ্যান। আর গোটা উপন্যাসজুড়ে আছে ভাবাবেগ, ভালোবাসা, বেদনা, ছলনা, হাহাকার ও হারানোর এমন এক মিশ্রণ—যা মনকাঁটা হয়ে বারবার দিতে থাকে সুখানুভূতির চিনচিনে খোঁচা। মূলত নারী-পুরুষের মনোজগতের বিষয়াবলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এই উপন্যাস। মনস্তাত্ত্বিক বোঝাপড়ার বিষয়টা এখানে মূখ্য।
উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র—সামি ও সামিরা। দুজনের মধ্যে হয়ে যায় মনের লেনাদেনা। সামি যেন এক মুক্তাবান ঝিনুক, যে তার হৃদয়ের অমূল্য মুক্তাটি প্রেয়সীকে দান করে দেয়। সামিরাকে সে ভালোবাসে নিজের সবকিছু দিয়ে। তার দেওয়া কাঁটার আঘাতগুলোকে বরণ করে ফুলের টোকা হিসেবে; তার নোনা দরিয়ার জহর পান করে ইশকের সারাবান তহুরা মনে করে। অপরদিকে এমন সহৃদয় প্রেমিককে সামিরা নিজের কয়েদি বানিয়ে নেয়। কিন্তু খুবই চতুরতার সাথে সে এটা লুকিয়ে রাখে। সামির সামনে নিজেকে পেশ প্রেমবতী রূপে। প্রেয়সীর এই রূপ দেখে সামি চলে যায় ঘোরের জগতে। অতলান্তিক সেই জগত, তাই সে সেখান থেকে আর উঠতে পারে না। এদিকে সামিরা তার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় নতুন হাত ধরে। এভাবে প্রেম আর বেদনার এক অসম লেনাদেনা চলে দুজনের মধ্যে—যার পরিণতি হয় বিচ্ছেদ।
প্রেম-ভালোবাসার বিষয়টা এই উপন্যাসের একটি রূপক দিক। লেখক মূলত এর মাধ্যমে তার আদর্শিক চিন্তাধারাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। সামি আর সামিরা এখানে শান্তিকামী জনতা আর স্বৈরশাসকের দুটো প্রতীক। অথবা এটি ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি আর পশ্চিমা কৃষ্টি-কালচারের সংঘাত; হক আর বাতিলের চিরন্তন লড়াই। যার একটি চায় মুক্তি, আরেকটি চায় পরাধীনতা। একটি চায় অমিয় সৃজন, আরেকটি চায় সমূলে বিনাশ। যার একটি মানবতা, যে বিশ্বাস করে নিজেকে অপর্ণ করে দেয় পাশবিকতার হাতে, কিন্তু সে তার স্বভাব সুলভ আচরণটা করে বসে; তাকে গিলে নেয় আর হজম করতে গিয়ে টের পায়—এ এমন এক কাঁটা, যাকে গেলাও যায় না, ফেলাও যায় না!
এক কথায়—পুরুষোত্তম সত্যের আদর্শিক আখ্যান এই উপন্যাস।
আপাতত এটি আমার পাঠানুভূতি। বইটির অনুবাদ যদি বের করি, তাহলে একে ভূমিকার বদলে স্থান দেব।