রামপুরা থেকে কদমতলি যাব। আকাশ পরিবহন বাসে উঠলাম। বাসটা বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত মোটামুটি টেনে এলো। এখানে এসে পড়ল মহাজ্যামে। একটু একটু করে এগোয়, থেমে থাকে অনেকক্ষণ। পল্টন মোড়ের ট্রাফিক পার হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেল—যেখানে আমি বাসে উঠেছিলাম পৌনে ছয়টায়। জিপিও মোড়ে এসে পড়ল বিরাট জ্যামে। এবার ড্রাইভার ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইল। যাত্রীরা বিরক্ত মুখে ফোঁসফোঁস করতে লাগল।
আমি বসেছি বাসের মাঝখানে, জানালার পাশের সিটে। বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে আছি বাইরে। আধা ঘণ্টার রাস্তায় লেগে যাচ্ছে দুই ঘণ্টা—এটা ভেবেই এই বিরক্তি। যদিও এ কদিনের ঢাকাবাসে ব্যাপারটা একটু গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু জ্যামে পড়ার বিরক্তি গা-সওয়া লোককেও ক্ষিপ্ত করে তোলে। তারপরও বেশির ভাগ সময় একে মানিয়ে নিতে হয়। এই যেমন এখন ভাড়া গুনে মানিয়ে নিয়ে বসে আছি।
বিশ মিনিটের ওপরে হয়ে গেল বাসটা থেমে আছে। যাত্রীরা সবাই চরম বিরক্ত। কেউ কেউ ড্রাইভার-হেল্পারকে ধাতানি দিচ্ছে। এই বিরক্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকেও। বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো, থেমেই যেহেতু আছি, গল্পকারের চোখে থেমে পড়া পরিবেশটাকে দেখি না! এতে করে ভাবনার ঝুড়িতে জমা হবে গল্পের রসদ। এই ভেবে সন্ধানী চোখে দেখতে লাগলাম সবকিছু।
রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে বেড়ে উঠেছে একটা বটগাছ। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওপরটা উজ্জ্বল আর নিচটা আবছা অন্ধকার হয়ে আছে। এর মাঝে অচেতন হয়ে পড়ে আছে এক মধ্য বয়সী লোক। তার পরনের কাপড়ও ঠিকঠাক নেই। পুরোই বেহুঁশ অবস্থা। এর থেকে দু-পা সামনে একটা খোলা ডাস্টবিন। সেখানে ময়লা-আবর্জনার মাঝে বসে আছে পাঁচ-ছয়টি কিশোর-তরুণ। তাদের কথাবার্তা, শরীরের নড়াচড়া অন্যরকম। কাগজের মধ্যে হলুদ কী একটা ফুঁকছে। আঁচ করতে পারলাম, ছেলেগুলো নেশায় আসক্ত। নেশার প্রভাবে তারা এমন করছে।
অদূরে এক মহিলা ল্যাম্পপোস্টের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে মাথায় বিলি কাটছে। উকুন আনছে বোধহয়। হাতের নখে সেগুলো মারছে। পাশেই চিত হয়ে পড়ে আছে তার দুধের বাচ্চাটি। মহিলার কোনো খেয়াল নেই তার প্রতি। নিজের মনে মাথার উকুন মেরে চলছে। তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কত কত মানুষ। দুজন ভদ্র মহিলাকে দেখলাম এই মহিলার সামনে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল। বাচ্চাটির দিকে তারা কি আড়চোখে তাকিয়েছিল?
অনেকক্ষণ পর জিপিও মোড়ের ট্রাফিক পার হয়ে বাস থামল গোলাপ শাহ মাজারের একটু আগে। দেখি ডিভাইডারের মাঝে ব্যানার পেতে গোল হয়ে বসে আছে চারজন লোক। খুব হাসিখুশি হয়ে তারা আলাপসালাপ করছে। এদের একটু সামনে একটা ভ্যানে শুয়ে-বসে আছে পাঁচ-ছয়জন লোক। তারাও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। এমন সময় এক মধ্য বয়সী মহিলা এলো একটা বড় বালতি নিয়ে। এক ছেলের হাতে এটা দিয়ে বলল পানি এনে দিতে। হাতের ইশারায় টাকার কথাও বলল বোধহয়। কোনো হোটেলের ফরমায়েশি পানি হবে হয়তো। এদের মাঝখান দিয়ে এক বুড়ো মহিলাকে দেখি এক হাতে লাঠি, আরেক হাতে চটের গাট্টি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নিজের মনে।
বাস আরেকটু এগোলে দেখি মাজারের ডানপাশের বটগাছের বেদিতে বসে আছে এক ফকির বুড়ো। মাথার চুল জট পাকিয়ে আছে। এক যুবতি এসে তাকে কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করছে। লোকটা প্রচণ্ড ধমকের সাথে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। সে-ও নাছোড়বান্দির মতো তাকে সেটা দিতে চাচ্ছে। কাছে দাঁড়িয়ে এই তামশা দেখছে একদল মেয়েছেলে। এর সামনে মাজারের গোড়ায় আগর-ধুনি নিয়ে বসে আছে আরেক মহিলা। নিবিষ্ট মনে কিছু পড়ছে। এর মধ্যে দুজন লোক এসে কিছু টাকা ফেলে গেল কবরের ওপর। লাইটের আলোয় ৫০০ টাকার নোটগুলো জ্বলজ্বল করতে লাগল।
মাজারের সামনের গেটের বেদিতে বসে আছে একটি ছেলে। বয়স সাত-আট হবে। মুখটি খুব মলিন। ঘাড় ঘুরিয়ে বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কাউকে খুঁজছে কিনা! তার পাশে বসে আছে এক বুড়ো মহিলা। কোলে তার কাপড়ের বড় পুঁটলি। মহিলা নিজের মনে পান চিবিয়ে চলছে। আঙুলের ডগার চুনটুকু দুয়েকবার জিহ্বায় লাগিয়ে সেটি মুছে ফেলছে পাশে স্ট্যান্ড করা মোটর বাইকে—যাতে হেলান দিয়ে এক তরুণ ফ্লাইওভারের দিকে উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে।
মাজরের সামনের গোল চত্বরে বসেছে আরেক মেলা। এখানে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে-বসে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। একদল ছেলের সাথে এক মধ্য বয়সী মহিলা, আরেকটি তরুণী হাসাহাসি করছে। হাসির এক পর্যায়ে মহিলা একটি ছেলেকে মার দিতে তেড়ে এলো। কোনো কড়া কথা বলে ফেলেছে কিনা! ছেলেটিও চম্পট দিল। পাশে এক লোক বসে বসে বিড়ি ফুঁকছিল। সে উঠে মহিলাকে কিছু বলল। মহিলা তার সাথেও রেগে রেগে কথা বলতে গিয়ে হাসতে লাগল।
বাস একটু একটু করে এগোচ্ছে আর আমি এভাবেই দেখে চলছি গুলিস্তানের পথমুখগুলো। কতগুলো মুখ দেখব আর? কোনটা রেখে কোনটার দিকে তাকাব? এত এত পথমুখ, কী ভিন্ন তাদের রংঢং, রূপ-প্রকৃতি! কোনটাকে করব আমার গল্পের চরিত্র? ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলছি। বঙ্গবাজার, কাপ্তানবাজার ছাড়িয়ে বাস এগিয়ে চলছে নয়াবাজারের দিকে। বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে কদমতলি গিয়ে থামবে। সেখান থেকে সিএনজিতে করে আমি যাব কোনাখোলা ডায়মন্ডের গলি—সেখানে আছে জাবির, সে আজ তার মনখারাপের কথা বলে আমাকে ডেকেছে আর আমি শহর-নদী পেরিয়ে যাচ্ছি তার কাছে—তার মনপ্রসন্নের খোরাক নিয়ে!