প্রথম দেখার দিন
আমি যে পরিবারে জন্মেছি এবং যে পরিবেশের আলোবাতাস গায়ে মেখে বেড়ে উঠেছি, এখানকার কারও মুখে ‘শাহ সাহেব হুজুর’, ‘আনোয়ার শাহ হুজুর’ বা ‘মাওলানা আনোয়ার শাহ’—এ নামটি কিংবা সম্বোধনটি তাকে নিজে চেনার আগ পর্যন্ত শুনেছি বলে মনে পড়ে না। হাওর এলাকার এক চাষাভুষা পরিবারে এবং গৃহস্থালি পরিবেশে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল নিতান্ত একপেশে।
বড়িবাড়ি জামিউল উলুম মাদরাসায় পড়াকালীন—আমার ইবতেদায়ি জামাতগুলোতে—আমাদের একজন উসতাদ ছিলেন মাওলানা আনোয়ার খাঁ। তার বাড়ি ছিল পাশের গ্রাম এন সহিলায়। আমরা তাকে ‘সইলা হুজুর’ বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন জামিয়া ইমদাদিয়ার ফারেগ। ক্লাসের মধ্যে হুজুর প্রায় তার জামিয়াজীবনের স্মৃতিচারণ করতেন। তখনই হয়তো প্রথম শুনেছিলাম শাহ সাহেব হুজুরের নাম। তার মুখ থেকে শাহ সাহেব সম্পর্কিত একটি ঘটনা শুনেছিলাম এরকম :
শাহ সাহেব হুজুরের নাম রাখা হয়েছে ইমামুল আসর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ.-এর নামানুসারে। তিনি ছিলেন মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর মুহতারাম উসতাদ এবং সহিহ বুখারির শায়খ। মাওলানা আতহার আলী রহ. উসতাদের নামানুসারে—তার পাঁচটি ছেলে ভূমিষ্ট হয়ে মারা যাবার পর একমাত্র জীবিত এবং প্রথম ছেলের নাম রাখলেন আনোয়ার শাহ। মাওলানা আতহার আলী রহ. নাকি তার উসতাদ আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি রহ.-এর অসিয়ত অনুযায়ী এ নামটি রেখেছিলেন। আর এভাবেই আমি প্রথম শুনেছিলাম শাহ সাহেব হুজুরের নাম।
২০১১ সাল। বড়িবাড়ি মাদরাসায় তখন মকতব পাঞ্জমে পড়ি। সেসময় এ মাদরাসার বেফাকের মারকাজ ছিল জামিয়া ইমদাদিয়ায়। সেবছর বেফাক পরীক্ষা দিতে প্রথম শহুরে পরিবেশে আসি। জামিয়ার সাততলা ভবনের চারতলায় আবাসিক থেকে বেফাকের ইবতেদায়ি মারহালার পরীক্ষা দিই।
একদিন বিকেলবেলা। আসরের পর দেখলাম, জামিয়ার প্রাঙ্গণে মুহতামিম কার্যালয়ের সামনে একজন দপ্তরি একটা বড় তিরপল বিছিয়ে গেল আর ছাত্ররা বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসে তাতে জমায়েত হতে লাগল। চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধচোখে এ দৃশ্যটি দেখছিলাম। হঠাৎ আমার মুগ্ধতায় বিস্ময়ের প্রসাদ ছড়িয়ে জামিয়ার গেইট দিয়ে আবির্ভূত হলেন সৌম্যকান্তি চেহারার এক শায়খ। পরনে তার উজ্জ্বল সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা, মাথায় গোল টুপি। আমাকে খুব অবাক করল তার দাড়িগুলো। মেহেদিপাতার আবির মাখানো এমন লাল দাড়ি এই প্রথম দেখলাম।
তিনি গেইট দিয়ে ঢুকতেই চারপাশের সবাই সজাগ, সতর্ক আর তটস্থ হয়ে গেল। ছাত্রদের যারা নিচের মজমায় যায়নি, আমার মতো ব্যালকনি ধরে নিচে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে লাগল। তখনই একজনকে বলতে শুনলাম—‘এই শাহ সাব আইছেন। নিচে মজলিস অইতাছে।’ কথাটি শুনে কথকের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিনা মনে নেই, তবে আমার উন্মুখতা মুহূর্তের মধ্যে দীপান্বিত হয়ে উঠল। আমি ভয়ে বিস্ময়ে মুগ্ধতায় অপলক তাকিয়ে রইলাম দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাওয়া তার কায়াটির দিকে। মনে মনে দারুণ উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলাম—তিনিই তাহলে শাহ সাহেব হুজুর!
সেদিন চারতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তার মুখের দিকে। নিচের মজলিসে কী বয়ান হচ্ছিল এর কিছু শুনতে না পারলেও মুগ্ধচোখে দেখছিলাম তার বাচনভঙ্গি, হাত নাড়ানো এবং মাঝে মাঝে প্রাণবন্ত হেসে ওঠা। এরপর আরও দুদিন এভাবে ওপর থেকে তাকে নিরীক্ষণ করলাম। একদিন বিকেলবেলা আগ্রহান্বিত মনে একটু সাহস করে বসে গেলাম তার বৈকালিন মজলিসে। সেদিনের বয়ানের কিচ্ছুটি আজ মনে নেই, তবে যতটুকু সময় ওই মজলিসে হাজির ছিলাম, শুধু তাকিয়েই দেখছিলাম শাহ সাহেব হুজুরের মেহেদিরঙিন শশ্রুমণ্ডিত মুখখানি।
দীনি কথার মুগ্ধ জাদুকর
শাহ সাহেব হুজুর রহ. ছিলেন দীনি কথার একজন মুগ্ধ জাদুকর। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি কথাই ছিল জাদুমাখা। এর ওপরে সেটি যদি হতো দীন বিষয়ক কোনো কথা কিংবা ইসলামিক বয়ান, খুতবা বা ওয়াজ-নসিহত, তাহলে তার কথামালা এমনই দ্যুতিময় এবং প্রভাবক হয়ে স্ফুরিত হতো—যার প্রতিটি উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি এবং বাচনিক প্রতিক্রিয়া জনমনে তুলত তুমুল উদ্দীপনার জোয়ার। যে জোয়ারে ভেসে শ্রোতামন হয়ে ওঠত ঋদ্ধ, উদ্দীপ্ত, আপ্লুত, স্পন্দিত এবং স্পর্ধিতও।
শাহ সাহেব হুজুরের প্রথম বয়ান শুনেছিলাম ২০১২ সালে, তাড়াইলের ধলা ইউনিয়নের এক মাহফিলে। তখন আমি সাচাইল মাদরাসায় নাহবেমির জামাতে পড়ি। সহপাঠীদের সাথে রাতের বেলায় সাইকেলে করে শাহ সাহেবের ওয়াজ শুনতে গিয়েছিলাম। অনেক লোকের সমাবেশে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে বয়ানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনেছিলাম। তিনি স্টেজে ওঠে খুতবা দেওয়ার পর মাহফিলের পোস্টারে তার নামের আগে লাগানো ‘আল্লামা’ অভিধাটির চমৎকার বিশ্লেষণ করেছিলেন। বলেছিলেন—‘আল্লামা শব্দটির দুইটা উদ্দেশ্য। আল্লামা যদি হামজা দিয়ে হয়, তাহলে এর অর্থ অধিক কষ্টদাতা। আর আল্লামা যদি আইন দিয়ে হয়, তাহলে এটি অধিক জ্ঞানীর অর্থ বুঝাবে।’ পরে তিনি এ বিশ্লেষণের রেশ ধরে ইলম ও আলেমসমাজ নিয়ে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেছিলেন।
পরের বছর আমাদের সাচাইল মাদরাসার সালানা মাহফিলে তিনি প্রধান অতিথি হয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তখন তাড়াইলের যেকোনো জায়গায় শাহ সাহেবের মাহফিল থাকলে আমরা দল বেঁধে যেতাম তার মনোজ্ঞ আলোচনা শুনতে। এভাবেই আমি তার বয়ানের বিমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে উঠলাম।
শাহ সাহেবের বয়ান, খুতবা ও আলোচনা শোনার এ সিলসিলা সুদৃঢ় হয়েছে জামিয়ায় পড়ার বছরগুলোতে। প্রতি শুক্রবার শহীদি মসজিদের জুমার বয়ান খুব আগ্রহান্বিত হয়ে শুনতাম। আমার দুর্ভাগ্য, কোনো দিন মসজিদের নিচতলায় সামনাসামনি বসে হুজুরের বয়ান শুনতে পারিনি। চার বছরের জামিয়াজীবনে কখনো দুতলায় এবং বেশির ভাগ তিনতলার দক্ষিণ দিকে বসতাম। খতিবের মাইক্রোফোনে তার প্রতিটি উচ্চারণ ও বচনকে হৃদয় দিয়ে অনুভবের চেষ্টা করতাম। জামিয়ার সিরাত মাহফিলে হুজুরের উদ্বোধনী ভাষণটিও বেশ লাগত। টাউনের আশপাশে কোথাও তার মাহফিল থাকলে সেখানেও মাঝেমধ্যে যেতাম।
শাহ সাহেবকে হৃদয়ের বক্তা হিসেবে পেতাম খানকাহে আতহারে ছাত্রদের সাপ্তাহিক ইসলাহি মজলিসের বয়ানগুলোতে। অন্য সব ময়দানের বক্তা শাহ সাহেব থেকে খানাকাহে আতহারের বক্তা শাহ সাহেবকেই সবচেয়ে ভালো লাগত। এসময় তার আলোচনাগুলো আমাকে এবং আমার মতো তার বয়ানের কাঙাল জামিয়ার প্রতিটি ছাত্রকেই উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করত। মাঠের বক্তা আনোয়ার শাহ এদিন হয়ে উঠতেন আমাদের হৃদয়ের কথাকার ও ভাষ্যকার। আত্মগত গলায় বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো আমাদের সাথে গল্প করতেন। টুকিটাকি সব কথাবার্তা এবং ভাব ও মত বিনিময় করতেন।
আমার কাছে বেশ প্রাণবন্ত লাগত হুজুরের দরসি আলোচনা ও তাকরিরগুলো। কিতাবের ইবারত পড়ে তরজমা করার চেয়ে তিনি আমাদের দীনিয়াত সমঝানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই তার দরসগুলো শুধু কিতাবের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকত না, বরং বৈশ্বিক, বৈষয়িক নানাবিধ জ্ঞানবিজ্ঞান এবং আত্মপরিচর্যার মনোজ্ঞ কথাবার্তায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠত।
মোটকথা, আমার দেখা প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাহ সাহেবকে পেয়েছিলাম একজন কথার জাদুকর হিসেবে। তার দিকনির্দেশনাধর্মী বয়ান ও আলোচনাগুলো এবং হালকা চালের বৈঠকি কথাবার্তা—সবকিছুতেই ছিল অনন্য মোহন এবং জাদুর প্রভাব। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত থেকে সাধারণ দেহাতি লোকটি পর্যন্ত একবার শুনলেই তার বয়ানের মুগ্ধ শ্রোতা এবং কথার প্রেমিক হয়ে যেত। কারণ শাহ সাহেব হুজুরের মুখ থেকে বেরোত তাদের হৃদয়ের কথাটি; যে কথা শুনতে হৃদয় হতো ব্যাকুল।
কথার জাদুকর আনোয়ার শাহ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কথাগুলো এখনো রয়ে গেছে প্রেরণার উৎস হিসেবে। প্রতিটি আশেকে আনোয়ারের হৃদয়ের খোরাক জুগিয়ে যাবে তার কথা সম্পদগুলো।
বাগে আতহারের দরদি মালি
জামিয়া ইমদাদিয়াকে আমি সবসময় ‘বাগে আতহার’ (মাওলানা আতহার আলীর ইলমি কানন) বলে ডাকি। মৌখিক কথাবার্তায় জামিয়া বলি, কিন্তু হৃদয়ের সম্বোধনটি করে থাকি বাগে আতহার। এর সবটা জুড়ে আছে আল-আতহার সাহিত্য পাঠাগারের অবদান।
জামিয়ায় আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম বছর শরহে বেকায়া জামাত—২০১৫-১৬ সেশন। এ বছরের মাঝামাঝি থেকে সাহিত্য পাঠাগারে ‘আল-আতহার’ দেয়ালিকার কাজের দায়িত্ব পাই। তখন থেকে লেখাপত্রে জামিয়াকে বাগে আতহার বলে আসছি এবং হৃদয়মিনারে প্রতিস্থাপন করে নিয়েছি এ শ্রদ্ধান্বিত সম্বোধনটি। সেসময় লেখাপত্রে আমি যাকে শ্রদ্ধায় সমাদরে ভালোবেসে ডাকতাম ‘বাগে আতহারের দরদি মালি’ এবং সবসময় এই সশ্রদ্ধ সম্বোধনে ডাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি—তিনি আমাদের শাহ সাহেব হুজুর রহ.।
জামিয়াজীবনে বাগে আতহারের এই দরদি মালির তত্ত্বাবধান আমাদের জন্য ছিল আল্লাহর খাস রহমত। বাগানের প্রতিটি গাছের প্রতি মালির যেমন অপার নিষ্ঠা ও অশেষ ভালোবাসা থাকে, জামিয়ার প্রতিজন ছাত্র-শিক্ষক এবং সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের প্রতি শাহ সাহেবের ছিল এমনই দরদ ও অনুরাগ। এই ইলমের দুর্গে শাহ সাহেব ছিলেন অতন্দ্র প্রহরী। তার মমতার ছায়াতলে সকলে ছিলাম পরম শান্তি ও স্বস্তিতে।
জামিয়ার ব্যাপারে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সময়োচিত। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ছিলেন বাস্তবানুগ। পরিমিত সুযোগসুবিধার পরও ছাত্রদের কোনো অসুবিধা হলে তিনি দ্রুত এর দূরীকরণ ব্যবস্থা নিতেন। প্রায় মজলিসে তিনি এলান করতেন—‘ছাত্র-শিক্ষক পরস্পরের বন্ধু।’ তিনি নিজেও ছাত্রদের সাথে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো আচরণ করতেন। জামিয়াকেন্দ্রীক যেকোনো ইস্যুতে সবার আগে সরব হতেন। তার মতো এমন মহানুভব মুহতামিম জামিয়ার ইতিহাসে আরেকজন আসবে কি না সন্দেহ!
শাহ সাহেব হুজুরের জীবনে যদি কোনো উচ্চাভিলাষ থাকে, সেটা হলো জামিয়ার সার্বিক উন্নতি সাধন এবং সমৃদ্ধির প্রচেষ্টা। মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর এই ইলমি কাননের প্রযত্ন ও পরিচর্যায় তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। জামিয়ার প্রতি তার ছিল সীমাহীন দরদ এবং অপরিমেয় ভালোবাসা। এই দরদ ও ভালোবাসা তাকে সবসময় চিন্তামগ্ন রাখত। আনন্দে উদ্দীপ্ত আর বেদনায় আপ্লুত করত। জামিয়াকে নিয়ে তিনি ব্যথিত হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন—‘জামিয়ার ব্যথা আমারে খাইতে দেয় না, ঘুমাইতে দেয় না। এই ব্যথা আমার হাঁটুর ব্যথার চাইতেও বেশি। আমারে সবসময় টেনশনে রাখে।’ দরদি মালির এই ব্যথাতুর অভিব্যক্তি তার মুখে সবসময় গুঞ্জরিত হতো।
জামিয়া ইমদাদিয়া এবং মাওলানা আনোয়ার শাহ এমন দুটো নাম, যার একটি ছাড়া আরেকটি অসম্পূর্ণ। এ নাম দুটো আমার কাছে সমার্থক শব্দ বলে অনুমিত। ভবিষ্যতে যদি জামিয়াকেন্দ্রীক বা মাদরাসা ঘরানার শব্দাবলি দিয়ে কোনো শিক্ষা-অভিধান প্রণয়ন বাস্তবায়ন হয়, তাহলে জামিয়া ইমদাদিয়ার সমার্থক হিসেবে মাওলানা আনোয়ার শাহ এবং মাওলানা আনোয়ার শাহ-এর সমার্থক জামিয়া ইমদাদিয়াকে আনতে হবে। এটাই হবে জামিয়ার প্রোজ্জ্বল ইতিহাস এবং শাহ সাহেব হুজুরের মহত্তম জীবনালেখ্য।
আনা কাতিবু আনোয়ার শাহ
জামিয়াজীবনে আল-আতহার সাহিত্য পাঠাগারের সাথে আমার ছিল হৃদয়ের রিশতা। দিনরাতের কত উজ্জ্বল প্রহর আর আলোআঁধারি মুহূর্ত কাটিয়েছি সাহিত্য পাঠাগারে—বই পড়ায়, দেয়ালিকার কাজে, ব্যক্তিগত লেখালেখি আর সাহিত্যআড্ডায়—যা এখন শুধুই স্মৃতি। সেগুলোর মধ্যে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে আল-আতহার দেয়ালিকার জন্য শাহ সাহেব হুজুরের বাণী সংগ্রহের স্মৃতিটি।
জালালাইন, মেশকাত, দাওরা—এই তিন বছরের প্রতিটি দেয়ালিকায় আমি ছিলাম হুজুরের বাণীলেখক। এ মহিমান্বিত কাজে আমাকে আন্তরিক সহায়তা করেছে সহপাঠী খাইরুল ইসলাম। যখন কোনো দেয়ালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হতো, তখন আমি আর খাইরুল ভাই লেখা আহ্বান, লেখা সংগ্রহ, মনোনয়ন, সস্পাদনা—এসবের গোছগাছ করে বাণী আনতে শাহ সাহেবের কাছে যেতাম। লাল রংয়ের মোটা খাতাটি হাতে ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে তার পাশে দাঁড়াতাম। খাইরুল ভাই নমিত কণ্ঠে হুজুরকে জানান দিত আমাদের আসার কারণ। হুজুর কখনো ইশারায়, কখনো মুখে বলতেন বসার জন্য। আমি খাতাকলম খুলে চুপটি করে বসে যেতাম তার পাদদেশে। নির্নিমেষ চেয়ে তাকতাম তার মুখের দিকে—‘ওকতুব’ (লেখো!) শব্দটি শুনে আমর বিল কিতাবাত (লেখার আদেশ) পালনের জন্য।
হুজুর বিসমিহি তায়ালা বলে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে ভাবতেন। এসময় কখনো দেয়ালিকার বিষয় জানতে চাইলে খাইরুল ভাই নরম গলায় বিষয়ের জানান দিত। হুজুর বারকয়েক মাথা ঝাঁকিয়ে বলা শুরু করতেন তার অমূল্য অভিব্যক্তি। ভাবিত গলায় সমর্পিত কণ্ঠে চমৎকার ভঙ্গিমায় তার বাণী পেশ করতেন। আমি অনায়াসে তরতরিয়ে লিখে যেতাম, পুনর্বার জিজ্ঞাসার দরকার পড়ত না। লেখা শেষে হুজুরকে সবটুকু পড়ে শুনাতাম। সব ঠিক হলে হুজুর কখনো ব্যস বলে, কখনো ইশারায় চলে যেতে বলতেন। আর কোথাও কোনো ভুলচুক বা কিছু ছুটে গেলে আরেকবার বলে ওটা ঠিক করে নিতে বলতেন। তার বাণী হতো সর্বোচ্চ ৮/১০ লাইন, কিন্তু এ কথাগুলোর মাঝে সুপ্ত থাকত একটা শাহনামা’র উপাত্ত।
বাণী লেখার সময় আমি খুব সতর্ক থাকতাম—যেন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনো ভুলচুক না হয়ে যায়। একবারের ঘটনা। মেশকাতের বছর পাঠাগারের আয়োজনে মাওলানা আতহার আলী রহ.-কে নিয়ে একটি আধুনিক দেয়ালিকা—হাতের লেখার বদলে প্রিন্টিংয়ে—করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। কাজের গোছগাছ করে আমি আর খাইরুল ভাই হুজুরের কাছে বাণী আনতে গেলাম।
জামিয়ার চত্বরে বসে হুজুর বাণী দিচ্ছিলেন আর আমি তার পাদদেশে বসে লিখছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ‘তাঁকে’ শব্দটি এলো। হুজুর শব্দটিতে চন্দ্রবিন্দুর উচ্চারণে পুরো বাক্যটি বললেন, কিন্তু আমি লিখলাম চন্দ্রবিন্দু ছাড়া—তাকে। খেয়াল করিনি, লেখার সময় তিনি আমার খাতায় তাকিয়ে ছিলেন। শব্দটি ‘তাকে’ লিখতেই হুজুর আঙুল দিয়ে ভুল ধরিয়ে দিলেন—‘তাঁকে লেখো। ওপরে একটা চন্দ্রবিন্দু দাও।’ ভয়ে বিস্ময়ে তাঁর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে কথামতো কাজ করলাম।
তখন আমি তাকে শব্দটি সবখানে চন্দ্রবিন্দু ছাড়া লিখতাম এবং জানতাম এভাবেই সঠিক। কিন্তু পরে দেখলাম, তাকে শব্দটি যদি কোনো সম্মানিত বা বিশেষ ব্যক্তির সর্বনাম হয়ে আসে, তাহলে এর ওপর চন্দ্রবিন্দু বসে—তাঁকে হয়। হুজুরের কাছ থেকে বানানবিষয়ক এ সবকটি আজীবনের জন্য খোদাই করে নিয়েছি আমার করোটিতে। (সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে নিয়ম এসেছে, ‘তাকে’ শব্দটি চন্দ্রবিন্দু ছাড়াও লেখা যায়। এ নিয়মটিই আমি অনুসরণ করেছি এই লেখায়।)
দেয়ালিকার লেখাজোকা, আঁকাআঁকি তথা কাজ সম্পূর্ণ হয়ে এলে হুজুরের সামনে এর পাঠোন্মোচন হতো। তখন কাজের রুচিশীলতা দেখে তিনি খুব খুশি হতেন এবং উপযুক্ত প্রশংসা করতেন। মেশকাতের বছর প্রথম দেয়ালিকাটি করেছিলাম হাতের লেখায়। বরাবরের মতো এর অলঙ্করণ করেছিল খাইরুল ভাই। দিনটি ছিল কুরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে জামিয়া বন্ধের দিন। সেবারের দেয়ালিকার বিষয় ছিল ঈদুল আজহা। কাজটা করেছিলাম গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে—নতুন আঙ্গিক ও বিন্যাসে। তাই গোছগাছে একটু বিলম্ব হয়ে বন্ধের দিন ধরে এলো। হুজুরের সামনে পাঠোন্মোচন ছাড়া দেয়ালিকা টাঙাতে পারছি না।
সেদিন মাদরাসায় আসতে হুজুরের একটু দেরি হচ্ছিল। দেয়ালিকা হাতে খাইরুল ভাই চলে গেল তার বাসায়। ওখানে হুজুরের বাণীতে সাক্ষর নিয়ে পাঠোন্মোচন করে নিল। খাইরুল ভাই বলেছিল, কাজের বাহার ও রুচিশীলতা হুজুর দেখে খুব পুলকিত হয়েছিলেন এবং দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। একটু পর আমিও পেলাম এর চাক্ষুষ প্রমাণ।
হুজুর শহীদি মসজিদে ছাত্র-শিক্ষক ইজতিমা শেষে মুহতামিম কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আর খাইরুল ভাই মেশকাতের বারান্দায় ব্যালকনি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হুজুরকে আসতে দেখে ভয়ে শ্রদ্ধায় গ্রিলের সাথে সেঁটে যেতে লাগলাম। আমাদের সামনে এসে হুজুর থামলেন। খাইরুল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটি প্রাণবন্ত হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘কিরে খাইরুল, তুই তো আমারে দেয়ালিকার কাজ দেহায়া অবাক কইরে দিসছ!’ বলে হুজুর মুচকি হেসে চলে গেলেন। আমরা চমকে পুলকে বাক হারিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম।
মাওলানা আতহার আলী রহ.-কে নিয়ে আধুনিক দেয়ালিকার পাঠোন্মোচনও হুজুরের সামনে করা হয়েছিল। কাজের অভিনবত্ব দেখে হুজুর খুব খুশি হয়েছিলেন এবং আমাদের হৃদয় থেকে আন্তরিক জাযাকাল্লাহ ও নেক দোয়া দিয়েছিলেন। আর এভাবেই শাহ সাহেব হুজুর ছাত্রদের প্রতিভার মূল্যায়ন এবং সুকুমার মনোবৃত্তির পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন।
আমাকে তিনি বিশেষ করেছেন
মেশকাতের বছর—২০১৭-১৮ সেশন। আল-আতহার সাহিত্য পাঠাগার থেকে বানিয়ে জামিয়া মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর ওপর একটি স্মারক প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হলো। আয়োজনের সারথি ছিলাম আমি আর খাইরুল ভাই। আল-আতহারের ভালোবাসাই আমাদের এই কাজে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করেছিল।
দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার আগে কোনো একদিন সাহিত্য পাঠাগারে কাজে ব্যাপৃত কিংবা পাঠে নিরত এক সময়ে আমাদের মাথায় এসেছিল স্মারক প্রকাশের পরিকল্পনাটি। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট আলাপ-শলা করলাম। অনুপ্ত পরিকল্পনাটি মুখে করে নিয়ে গেলাম মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর ইয়াদগার শাহ সাহেব হুজুরের কাছে। খাইরুল ভাইকে দিয়ে কথাটি হুজুরকে জানালাম। আমাদের আধখেঁচড়া পরিকল্পনা শুনে হুজুরের মুখটি প্রদীপ্ত হয়ে উঠল। তিনি এ সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা করলেন, কাজের অনুমতি দিলেন এবং মনের জমিনে বপন করে দিলেন আতহারি চেতনার বীজ। হুজুরের অনুপ্রেরণায় প্রাণিত হয়ে দুই আনকোরা মানিকজোড় আতহারি ভালোবাসার জোরে কাজ শুরু করলাম।
আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব এবং প্রখ্যাত মনীষীকে নিয়ে কাজটা করব বেশ আয়োজন করে। কিন্তু ছাত্রত্বের বাঁধন আমাদের বাধ্য করল নিজেদের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে কাজ করার। আমি আর খাইরুল ভাই যেখানেই মাওলানা আতহার আলী রহ.-কে নিয়ে একটু কুশলের সন্ধান পেতাম, ভোমরের মন নিয়ে সেখানে উড়ে যেতাম। এভাবে দুই-আড়াই মাস অবিরত দৌড়ঝাঁপ করে কাজটাকে গুছিয়ে আনলাম।
সব কাজ সম্পূর্ণ হবার পর একটু দ্বিধায় পড়লাম প্রকাশনা নিয়ে। ভারি দোলাচলে ছিলাম, স্মারকটি আদৌ প্রকাশ হবে কি না! কারণ এই কাজে নেমে আমাদের অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু এসব কিছুকে আতহারি ভালোবাসার ছোঁয়ায় দূর করে আমাদের কাজকে আলোর মুখ দেখালেন শাহ সাহেব হুজুর। সম্পূর্ণ নিজের খরচে স্মারকটি প্রকাশ করলেন। আশেকানে আতহারের সমীপে পেশ করলেন—‘স্মৃতির আয়নায় দেখা প্রিয়মুখ’ বইটি।
স্মারকের লেখা সংগ্রহের কাজ তখন প্রায় শেষ। লেখার জন্য শুধু একজন বাকি—মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর ইয়াদগার (স্মৃতিসৌধ—যার কাছে সবচেয়ে বেশি স্মৃতি গচ্ছিত) শাহ সাহেব হুজুর। আমি আর খাইরুল ভাই হুজুরের কাছ থেকে লেখা নেওয়ার সুযোগ খুঁজি।
একদিন হুজুরকে একা পেলাম—মুহতামিম কার্যালয়ের সামনে তার জামিয়া পরিচালনার আসনে বসে আছেন। কাগজকলম হাতে তখনই ছুটলাম। আমি একা একা হুজুরের কাছে যেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। তালিমাত দপ্তরে মাওলানা আবদুল মতিন সাহেবের কাছে গেলাম। হুজুর আমাকে নিয়ে গেলেন শাহ সাহেবের কাছে। আমার হয়ে হুজুরকে বললেন আসার কারণ। হুজুর লিখতে বললেন।
আমি বিসমিহি তায়ালা লিখলাম। হঠাৎ হুজুরের কণ্ঠে অনুরণিত হলো ‘বসো’ শব্দটি। চমকে ওঠে তার মুখের দিকে তাকালাম। হুজুর আমাকে সরাসরি নির্দেশ দিলেন, ‘বসো। বসে লেখো।’ বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, আবদুল মতিন সাহেব তালিমাত থেকে একটি চেয়ার এনে আমার পেছনে পেতে দিয়েছেন আর শাহ সাহেব হুজুর সেখানে বসতে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু আমি কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
ক্লাস চলাকালীন জামিয়াজুড়ে উসতাদদের আনাগোনা, দপ্তরিদের বিস্মিত চাহনি, ব্যালকনিতে ছাত্রদের কৌতূহলী মুখ—এসবের মধ্যে স্বয়ং জামিয়া প্রধান এবং শাহ সাহেব হুজুরের মতো এমন বিশাল মহীরুহের মুখোমুখি বসতে আমার ভেতর উদ্বেগ ও সংকোচ তোলপাড় করছিল। কিন্তু আবারও ভেসে এলো হুজুরের নরম গলার কড়া নির্দেশ, ‘আরে বয়া ফড়ো। বয়া লেখতে সুবিধা অইব। জুইত পাইবা।’ এরপর আর ভয়-দ্বিধা চলে না। এই নির্দেশ অলঙ্ঘনীয়।
সেদিন এভাবে আধঘণ্টার ওপরে শাহ সাহেবের মুখোমুখি হয়ে চেয়ারে বসেছিলাম আর কাঁপা কাঁপা হাতে লিখেছিলাম, মাওলানা আতহার আলী রহ.-কে নিয়ে হুজুরের মুখনিঃসৃত প্রতিটি মুক্তোবচন। লেখার সময় জামিয়ার অনেক সিনিয়র উসতাদ শাহ সাহেবের কাছে এসেছিলেন নানা দরকারে। কিন্তু হুজুর ছিলেন স্মৃতিচারণে নিবিষ্ট। সিনিয়র হুজুররা তার এই নিমগ্নতা দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমার লেখার কাজ পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলেন। ওদিকে জামিয়ার প্রতিটি ব্যালকনি এবং মাঠের সবখানে দেখা যাচ্ছিল ছাত্র আর দপ্তরিদের কৌতূহলী মুখ। আমি আড়চোখে ইতিউতি করে উৎকর্ণ হয়ে লিখে যাচ্ছিলাম শুধু।
সেদিন শাহ সাহেব হুজুরের মতো বিশাল মহীরুহ ব্যক্তিত্ব আমার মতো আগাছাকে তার উদারতার ছায়ার বসে যেভাবে বিলাসের ‘প্রশ্রয়’ দিয়েছিলেন, এই প্রশ্রয় আমাকে উদ্দীপ্ত করেছে আনোয়ার শাহ-এর প্রতিটি অবদানকে নিজের রক্ত দিয়ে সঞ্জীবিত রাখতে। ইতিহাসের মহানায়ক আনোয়ার শাহ-এর একজন খুদে সৈনিক হয়ে তার আদর্শ ও মিশনকে বাস্তবায়ন করতে আমি মুজিব চিরকালই ‘মুজিব’ (সাড়াদানকারী) হয়ে থাকব—তাওফিক দিয়ো আল্লাহ!