জলধোয়া আয়নার মতো শরতের মেঘমেদুর আকাশ। দিনঘড়ি হয়ে ঝুলে থাকা সূর্যটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে। সোনাঝরা রোদের ঘূর্ণায়মান কাঁটায় জানান দিচ্ছে বিকেলের বার্তা। দিনের এই ঋদ্ধ প্রহরকে সাক্ষী রেখে আমরা প্রবেশ করলাম টাউন হল প্রাঙ্গণের ইসলামি বইমেলায়। আমি আর খাইরুল ইসলাম, দুজনের প্রধান পরিচয় পড়ুয়া। বইমেলা লেখক-পাঠকের মিলনমেলা, এ ধারার লোকজন এখানে বেশি আসবে। আমাদের আসাটা এ উপলক্ষ্যে হলেও মূল উদ্দেশ্য হলো, ইসলামি সাহিত্যের অন্যতম দুই দিগদর্শী মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন ও ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর সাক্ষাৎ লাভ এবং সান্নিধ্য গ্রহণ। সাহিত্যের মোহন সৌরভ ছড়াতে আজকে তারা প্রধান মেহমান হয়ে আসছেন এখানে।
ময়মনসিংহের ইসলামি বইমেলায় এবারই আমার প্রথম আসা। ইসলামি বইমেলা হিসেবে অভিহিত হলেও আদতে এটা সর্বজনীন। তবে যেহেতু রবিউল আওয়াল মাসকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এজন্য সজ্জিত হয়েছে ইসলামি আবহে এবং গুরুত্বের দিক দিয়ে লাভ করেছে অনন্যতা। কারণ এই মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবিজীবনের সবিশেষ দুটি দিক—পৃথিবীর বুকে তার শুভাগমন ও মহাপ্রস্থান। তাই বছর ঘুরে যখন রবিউল আওয়াল আসে, উম্মতে মুহাম্মদির জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়ায়—সিরাতে রাসুলের অমিয় ঐশ্বর্যে সার্থক ও সমৃদ্ধ করে নেওয়া মানবজীবন। রাসুলের সিরাত মানবতার প্রাণপ্রদীপ, যার দ্বারা পাওয়া যায় দীপান্বিত জীবনের দিশা।
এদিক থেকে ইসলামি বইমেলার আয়োজন ও পরিবেশ দারুণ মনোজ্ঞ লাগল। চোখে পড়ল সর্বশ্রেণির পাঠকদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি। মাদরাসা ঘরানার লোকজন তো আছেনই, স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা এবং সাধারণ লোকজনও আসছেন, বই কিনছেন, ঘুরে দেখছেন। বই যে মানুষের পরম বন্ধু, নিজের চোখে পেলাম এ কথাটির প্রদীপ্ত প্রমাণ।
অমিয় অভিবাদন
বৈকালীন আবহে জমে উঠেছে বইমেলা। আচমকা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মেঘের ম্লানিমা মুছে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল ঝলমলে রোদ। ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের আনাগোনা। তাদের স্রোতে মিশে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম বিভিন্ন স্টল। পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলো। আবদুল্লাহ মারুফের অপেক্ষায় ছিলাম। লেখক কর্নারের সামনে তার দেখা মিলল। কুশল বিনিময়ের পর হাতে পেলাম ‘বইমেলা প্রতিদিন’ ক্রোড়পত্রটি। ইসলামি বইমেলার প্রতিদিনকার আমেজকে ধরে রাখতেই এই বিশেষ আয়োজন। কাজটা যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনই সাহসিক। নান্দনিক আয়োজনে প্রতিদিন পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের হাতে হাতে।
এখানে মাহমুদুল হাসান জুনাইদ সাহেব ও কামরুল হাসান সাহেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হলো। ক্রোড়পত্রটির মূল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত তারা। দুজনেই কথাবার্তা ও আচার-ব্যবহারে অত্যন্ত আন্তরিক ও অমায়িক। জানতে পারলাম, ঢাকা থেকে আগত মেহমানরা এরমধ্যে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বইমেলার প্রাঙ্গণে হাজির হবেন।
আমি, আবদুল্লাহ মারুফ ও কামরুল হাসান সাহেব আসরের নামাজ পড়তে চলে গেলাম কাচারি মসজিদে। নামাজ শেষ করতেই খাইরুল ভাইয়ের ফোন। জানালেন, মেহমানরা চলে এসেছেন এবং সাইফ সিরাজ ভাই আমার খোঁজ করছেন। খবর পেয়ে আমরা চটজলদি হাজির হলাম বইমেলায়। লেখক কর্নারের সামনে স্থানীয় অনলাইন বইগ্রুপের একটি অনুষ্ঠান চলছিল। দেখলাম এর অদূরে চা-চক্রের মতো বৈঠক জমিয়ে বসে আছেন প্রধান মেহমানরা।
চাঁদকে ঘিরে যেমন তারার হাট বসে, তেমনই তাদেরকে ঘিরে জমে উঠেছে মজমা। পাশাপাশি বসে আছেন যাইনুল আবিদীন সাহেব, ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী সাহেব ও হুমায়ুন আইয়ুব ভাই। আমি পুলকিত মনে দীপ্ত মুখে এগিয়ে গেলাম। প্রথম সাক্ষাৎ করলাম ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী সাহেবের সঙ্গে। মুসাফাহার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে উঠলেন, ‘মুজিব না তুমি? ভালো আছো?’ প্রথম দেখায় তিনি আমাকে চিনবেন এবং আন্তরিক গলায় কুশল জিজ্ঞেস করবেন, এটা ভেবে আশ্চর্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। জবাবে শুধু হাসিমুখে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লাম। মুসাফাহা করলাম হুমায়ুন আইয়ুব ভাইয়ের সঙ্গে। পূর্ব পরিচিতির সুবাদে তার সঙ্গে আন্তরিক কুশল বিনিময় হলো।
যাইনুল আবিদীন সাহেব একজনকে অটোগ্রাফ দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। এ অবস্থায় হুমায়ুন আইয়ুব ভাই আমার দিকে ইশারা করে তাকে বললেন, ‘হুজুর, ও মুজিব হাসান, শাহ সাহেব হুজুরের স্মারকের কাজের দায়িত্বে আছে।’ তিনি অটোগ্রাফ শেষ করে আমার দিকে তাকালেন। স্মিতমুখে বললেন, ‘চিনি ওকে, আমার বাসায় সাক্ষাৎ হয়েছিল।’ মুসাফাহার জন্য হাত বাড়ালাম, তিনিও এগিয়ে দিলেন নিজের হাত। ততক্ষণে ওই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেছে এবং সবার ডাক পড়েছে এই মৌয়ালদের সঙ্গে মধুকথার সাহিত্য মাহফিলে সমবেত হতে।
প্রথম অধিবেশন
পড়ন্ত বিকেল। বইমেলার ইসলামি আবহে একঝাঁক পড়ুয়াদের নিয়ে শুরু হলো সাহিত্য মাহফিল। মধ্যমণি হিসেবে আছেন নন্দিত গদ্যশিল্পী মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, সিরাত সাহিত্যিক ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী, লেখক, সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব, কবি, গীতিকার সাইফ সিরাজ প্রমুখ। কবি, আবৃত্তিকার ওয়ালিউল ইসলামের সঞ্চালনায় আরম্ভ হলো মাহফিল। বইমেলার আয়োজন নিয়ে আয়োজকদের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য রাখলেন সিরাতকেন্দ্রের পরিচালক আমির ইবনে আহমদ। শিল্প-সাহিত্যের উর্বর শহর ময়মনসিংহে যেন প্রতি বছরই এরকম প্রাণবন্ত ইসলামি বইমেলার আয়োজন হয়, সেই আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
আগত অতিথিদের মধ্যে প্রথমে বক্তৃতা নিয়ে এলেন ঔপন্যাসিক, গল্পকার ফজলুল হক তুহিন। তার আলোচনায় ইসলামি সাহিত্য এবং সৃজনশীল সাহিত্যের মধ্যে পার্থক্যের একটা ব্যাপার উচ্চারিত হলো। তার সারকথা ছিল, ইসলামি সাহিত্য বলতে প্রবন্ধ-রচনার ব্যাপারটি মূল, গল্প-উপন্যাসের দিকটি এখানে গৌণ। অন্যদিকে সৃজনশীল সাহিত্য সমাজকে প্রমোট করে। এজন্য যারা ইসলামি সাহিত্য শীলন করেন, তাদের উচিত সৃজনশীল সাহিত্যকে প্রাধান্য দেওয়া।
তারপর বক্তৃতা নিয়ে এলেন লেখক, সাহিত্যিক ফারুক আযম। তার আলোচনায় ফুটে উঠল ইসলামি সাহিত্য শীলনের দিকটি। তিনি তরুণদের ইসলামি সাহিত্য শীলনে ব্রত হওয়ার আহ্বান জানালেন এবং লেখালেখিতে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মাণের আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
দীপিত মুখে বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন লেখক, সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব। তার আলোচনার সারকথা ছিল, ইসলামি বইমেলার মাধ্যমে দাওয়াতের কাজ হচ্ছে। এই কাজে তরুণদের বেশি এগিয়ে আসা উচিত। বড়দের স্বপ্ন পূরণ হবে তরুণদের দিয়েই। সাহিত্য শীলনের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণের পথচলা সহজ হবে।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মসজিদ থেকে ভেসে এলো মাগরিবের আজান। এবার নামাজের বিরতি ঘোষিত হলো। হাইয়্যা আলাস সালাহর ডাকে সাড়া দিতে এগিয়ে চললাম টাউন হল মোড়ের মসজিদে।
দ্বিতীয় অধিবেশন
নামাজের পর শুরু হলো দ্বিতীয় অধিবেশন। লোডশেডিং চলছে। বইমেলার স্টলগুলোতে সবাই নিজেদের মতো আলোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে। একটি টিউব লাইট এবং স্মার্টফোনের ফ্লাশ লাইটে আলোকিত করা হলো মাহফিল-প্রাঙ্গণ। শুরুতে ইউসুফ বিন মুনীর মনোজ্ঞ নাত পরিবেশন করে মুগ্ধ করে তুললেন শ্রোতামন।
এই অধিবেশনের প্রথমে বক্তৃতা নিয়ে এলেন কবি, গীতিকার সাইফ সিরাজ। তার কথার প্রারম্ভে মাহফিলের দুই মধ্যমণি যাইনুল আবিদীন সাহেব ও ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী সাহেবকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বললেন—‘আমাদের তরুণ প্রজন্মের উচিত তাদেরকে মূল্যায়ন করা। আমরা যদি বড়দের মূল্যায়ন করতে পারি, তাহলে একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ গঠন করা সম্ভব। সাহিত্য শীলনের ক্ষেত্রে বড়দের সংস্পর্শ ও কাউন্সিলিং তরুণদের জন্য অতি আবশ্যকীয় এবং খুবই দরকারি।’
এ সূত্র ধরে নিজের সাহিত্য শীলনের ক্ষেত্রে বড়দের সংস্পর্শ পাওয়ার একটি অনুস্মৃতির কথা বললেন।
বয়ান মোহন—১
মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়ালেন নন্দিত লেখক ও সিরাত সাহিত্যিক ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী। তার কথা বলার শুরুতেই চলে এলো বিদ্যুৎ। আলোকিত হয়ে উঠল চারদিক। এ আলোকময়তার ভেতরে দীপিত মুখে তিনি আরম্ভ করলেন বক্তৃতা। আলো-অন্ধকারের প্রত্যক্ষতার সূত্র ধরে বলতে লাগলেন—‘অন্ধকার যত নিশ্ছিদ্র হোক, এক ফোঁটা আলোই তা দূর করার জন্য যথেষ্ট। আজকের এই ইসলামি বইমেলা অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব। আলো ছড়িয়ে দেওয়ার বিপ্লব, চারদিক জাগিয়ে তোলার বিপ্লব।’
সিরাতের বইমেলাকেন্দ্রিক শিক্ষার সূত্র ধরে বললেন—‘আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ইসলামের মহান বাণীকে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা আসার সময় আল্লাহর রাসুল সম্পূর্ণ একা ছিলেন। এরপরও তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন কালিমার দাওয়াত নিয়ে, আলোর সওগাত হাতে। তারপর একে একে যুক্ত হলেন অনেকে। এভাবে গড়ে উঠল ইসলামের আলোর কাফেলা।’
সাহিত্য শীলনের পথনির্দেশ দিতে গিয়ে তিনি বললেন—‘হৃদয় থেকে উৎসারিত কথামালা হৃদয়কে স্পর্শ করবে, এটাই তো সাহিত্য। এছাড়া যা আছে, সবই জীবাণু সাহিত্য; তা সুস্থ মন-মানসিকতাকে বিনষ্ট করে দেয়। কুরআন ও হাদিসের উৎস থেকে সাহিত্য শীলন করতে হবে, এতেই মিলবে মুক্তি। যার যোগ্যতা আছে একটি লাইন লেখার, পত্রিকা বের করার এবং বই প্রকাশ করার, তাকে অবশ্যই তা করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের শিশু-কিশোরদের জন্য রচনা করতে হবে সৃজনশীল সাহিত্য, যাতে তারা সুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।’
শেষে সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর একটি চমৎকার গল্প বললেন। তিনি যখন আবুল ফারাজ ইসফাহানির ‘কিতাবুল আগানি’ পড়লেন, তখন এর সাহিত্য মধুরিমায় বিমোহিত হওয়ার বদলে হলেন নিদারুণ বেদনাহত। কারণ এখানে আরবি ভাষার মতো একটি পবিত্র ভাষাকে অশ্লীলতার বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে! তখনই তিনি সংকল্প করলেন, আরবি ভাষায় একটি কিতাব লিখবেন, যেটি হবে ভাষা ও বিষয়ের দিক দিয়ে চমকপ্রদ ও উপকারী। তারপরই লিখলেন ‘ইযা হাব্বাত রিহুল ঈমান’ কিতাবটি—ভাষার মধুরিমায় যাতে বাঙময় হয়ে উঠেছে সাইয়িদ আহমদ শহিদ রহ.-এর জীবন ও জিহাদ।
এর সূত্র ধরে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পবিত্র মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার কথা বললেন। পরিশেষে ইসলামি সাহিত্যের বিকাশ ও প্রসারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেষ করলেন তার বক্তৃতা।
বয়ান মোহন—২
দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মনোহরী বক্তৃতার পরাগ ছড়াতে দাঁড়ালেন নন্দিত গদ্যশিল্পী, জাদুকরী লেখক মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। সবার ভেতরে পুলকের দোলা লাগল, আমার ভেতরে বয়ে গেল মোহনীয় আনন্দের স্রোত। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ের এ কথাটি দিয়ে—‘আহমদ ছফাকে তার গুরু অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, আপনি যখন কোনো নতুন জায়গায় যাবেন, তখন দুটি জিনিস দেখবেন : ১. সেখানকার লোকেরা কী খায় এবং ২. কী পড়ে। ময়মনসিংহের বইমেলায় এসে এ বিষয়টি আমাকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। এর আগে যখন বড় মসজিদের প্রাঙ্গণে বইমেলা হতো, তখনো আমার আসা হয়েছে। এবার ইসলামি আবহে যে বইমেলা হচ্ছে, এটা সর্বজনীন। দেখতে পাচ্ছি সর্বশ্রেণির পাঠকের আনাগোনা আছে এখানে। মূলত বইমেলার পেছনের শক্তি পাঠকরাই।’
সৃজনশীল লেখালেখির হতাশা ও প্রতিকার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বললেন—‘হুমায়ূন আহমেদ যখন ‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাস লেখা শুরু করেন, তখন সম্রাট হুমায়ুনের জীবনের দিকগুলো এত গোছালো পান, যার জন্য তাকে আলাদা রঙ ছড়ানোর কোনো দরকার হয়নি।’ তারপরই টানলেন সিরাতে রাসুলের প্রসঙ্গ—‘কিন্তু সিরাতে রাসুলের যে রং, কেউ যদি একে উপজীব্য করে লেখালেখি করে, তাহলে এর সুশোভা ও মধুরিমার জন্য তাকে আলাদা কোনো রং যুক্ত করতে হবে না। কেউ যদি সিরাতে রাসুলের রঙে রঙিন হতে চায়, আল্লাহ তায়ালা এতে এত রং রেখেছেন, কেয়ামত পর্যন্ত সে রঙিন হতে থাকবে। কারণ প্রিয় নবির জীবনের প্রতিটি দিকই তো একেকটি কবিতা।’
বই পড়া এবং বই পাঠের প্রচার-প্রসার নিয়ে বললেন—‘বই পড়া ছাড়া কোনো জাতি সম্মানিত হয় না। বইকে সম্মান করা মানে ওহিকে সম্মান করা। ওহি থেকে বহি, বহি থেকে বই। কিন্তু গভীর বেদনা নিয়ে একটা বিষয় লক্ষ্য করি, আমাদের দেশে যে বইমেলা হয় এবং এটা যে সাড়া ফেলার মতো ঘটনা, তা নিয়ে আমাদের মসজিদের মিম্বর থেকে কোনো আলোচনা করা হয় না। আমি মনে করি আমাদের আলোচকদের উচিত, বই পড়া এবং বইমেলার গুরুত্ব সমাজের কাছে তুলে ধরা।’
তরুণদের ইসলামি সাহিত্য শীলনের প্রতি ব্রত হওয়ার উপদেশ দিয়ে বললেন—‘আমাদের তরুণরা ইসলামি সাহিত্য শীলনের প্রতি মনোনিবেশ করুক। তাদের মাধ্যমে সূচনা হোক ইসলামি সাহিত্যের বিপ্লব। ইসলামকে উপজীব্য করে তারা লেখালেখি করুক। ইসলামি সাহিত্য বা লেখালেখি বলতে কেবল প্রবন্ধ রচনা নয়, এখানে গল্প-উপন্যাসের ধরনও আছে। এর আলোকে আমাদের তরুণরা ইসলামকে ছড়িয়ে দিবে বিচিত্রতায়।’
আলোচনার শেষ পর্যায়ে একটি চমৎকার প্রস্তাবনা তুললেন—‘আমাদের সমাজে সাধারণ ও অন্যান্য লাইব্রেরিগুলোর মতো সিরাত লাইব্রেরি গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হোক। আমাদের মাদরাসাগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। মাদরাসার পাঠাগারে শুধু সিরাতের বই-কিতাব নিয়ে একটি সিরাত কর্নার থাকুক।’
তখনই বইমেলার সিরাত কর্নারের কথা জানতে পেরে পুলকিত হয়ে বললেন—‘এখানে যেভাবে সিরাত কর্নারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এরকম করে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এজন্য আমি বইমেলার আয়োজকদের কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করছি, তাদের মাধ্যমে শুরু হতে পারে এই উদ্যোগ।’
সাহসিক উচ্চারণে একটি চরম বাস্তবতা তুলে ধরে বক্তৃতার শেষ টানলেন—‘সিরাতের বই-কিতাব পাঠ ও সংগ্রহে যারা আগ্রহী হয়, আমাদের কিছু বন্ধু তাদের হাতে ধরিয়ে দেয় ‘আর-রাহিখুল মাখতুম’ কিতাবটি। আজ আর চুপ করে থাকা যাবে না, বলতেই হবে—সালাফিরা যেখানে আমাদের ইতিহাসকে কামড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে, সেখানে কেন আমরা একজন সালাফির কিতাবকে আমাদের সন্তানদের হাতে ছড়িয়ে দেবো? এ সময়ে আমরা কেন বুক টান করে বলতে পারি না—সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভীর ‘নবীয়ে রহমত’, ইবনে হিশামের ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’, হাফেজ যাহাবির ‘সিরাতে নবুবিয়্যাহ’, হাফেজ ইবনে কাসিরের ‘আল ফুসুল’ এবং মুহাম্মদ মিয়ার ‘আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ’র কথা? এগুলো তো বিশুদ্ধ আকিদাসম্পন্ন আলেমদের বিশুদ্ধ কিতাব। এত কিছু থাকতে কেন তৈরি হবে শূন্যতা? আসুন, আমরা শূন্যতাকে পূরণ করব বিশুদ্ধ উচ্চারণে, বিশুদ্ধ বর্ণমালায়।’
সমাপনী
তন্ময় হয়ে শুনছিলাম যাইনুল আবিদীন সাহেবের আলোচনা। তার কথায় এত মোহন, মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে হয়। মনে হলো, তিনি হঠাৎ আলোচনা শেষ করে দিলেন। তিনি তো শেষ করলেন, কিন্তু আমার মনে রয়ে গেল দারুণ রেশ। ততক্ষণে সাহিত্য মাহফিলও শেষ হয়ে এসেছে। এবার আখেরি মুনাজাত।
সমাপনী বক্তব্য পেশ করলেন মুফতি মুহিব্বুল্লাহ সাহেব। ইত্তেফাকুল উলামার পৃষ্ঠপোষকতায়, সিরাতকেন্দ্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত ইসলামি বইমেলা ময়মনসিংহবাসীর সামনে এনে দিয়েছে বই কেনা ও পড়ার অনন্য সুযোগ। তাদের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য স্থানের লোকজন এই সুযোগটা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ করলেন সাহিত্য মাহফিল।