Skip to content
মুজিব হাসান
Menu
  • মুখপাতা
  • চিন্তানুড়ি
  • গদ্যলেখা
  • স্মৃতিকথা
  • জীবনপাঠ
  • গল্পগুচ্ছ
  • ধারাবাহিক
    • উপন্যাস
    • ভ্রমণগদ্য
  • আলাপঘর
    • মুখোমুখি
    • মুখাড্ডা
  • দেরাজ
    • পাণ্ডুলিপি
    • পাঠানুভূতি
    • চিঠিপত্র
  • খোলা বই
  • বিশেষ আয়োজন
Menu

কুশলের খোঁজে, আলোর পরশে

পোস্ট করা হয়েছে জুন ২৬, ২০২৪জুলাই ৮, ২০২৪ by মুজিব হাসান

চট্টগ্রামের পথে

হেমন্ত রাতের আড়মোড়া ভেঙে প্রভাতি মুখরতায় জেগে উঠল চট্টগ্রাম মহানগরী। ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনটি স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে এসে থামল। একদল শশব্যস্ত যাত্রীর সঙ্গে আমরা নিচে নেমে এলাম। রাতের বেলায় ট্রেনজার্নি আমার কাছে সবসময় উপভোগ্য। তবে আজকের জার্নিটা বেশ ভুগিয়েছে। এক্সপ্রেস ট্রেন, কিন্তু চলেছে একদম লোকালের মতো। সিটগুলো পড়েছে বিক্ষিপ্ত। আমি আর খাইরুল ভাই—আমাদের দুজনের সিট পড়েছে ময়মনসিংহের কম্পার্টমেন্টে; ওদিকে কিশোরগঞ্জের কম্পার্টমেন্টে ইয়াসিন। ভেবেছিলাম তিনজন একসাথে গালগপ্পো করতে করতে যাব, কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠল না। প্লাটফর্মে নেমে চেকপোস্টে যেতে যেতে তিনজন এক হলাম।

স্টেশনের বাইরে এসে একরাশ ভালো লাগায় মন ভরে উঠল। চট্টগ্রামের সকালগুলো স্নিগ্ধতায় মোড়ানো। এখানে সূর্য ওঠে কমলের কোমলতা নিয়ে। সাগর-হাওয়ার ঝাপটা আর পাহাড়ি-শ্যামলিমার মৌতাত একীভূত হয়ে মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে একবার ভেবে নিলাম আমাদের কর্তব্যের কথা। যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি—আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর স্মারকগ্রন্থের কাজে, মহিরুহ মনীষীদের সাক্ষাৎকার ও সান্নিধ্যগ্রহণে—সেটি আমাদের জন্য যে সৌভাগ্যের ডালি নিয়ে আসছে, মনে মনে এর সুফল গুনে একইসঙ্গে উদ্দীপ্ত ও আপ্লুত হয়ে উঠলাম।

জামিয়া দারুল মাআরিফ : স্মৃতির জোনাকি জ্বলে

আমাদের প্রথম গন্তব্য জামিয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া; আল্লামা সুলতান যওক নদভীর সাক্ষাৎকার ও সান্নিধ্যগ্রহণ। আমি আর খাইরুল ভাই এসেছি মূল কাজে, ইয়াসিন এখানকার ছাত্র; কুল্লিয়া রাবে জামাতে পড়ছে। গত বছর আমিও ছিলাম ওর সহপাঠী। আরবি সাহিত‌্য পড়ার উচ্চাশা নিয়ে দুজন একসাথে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি কেবল শুবাতুল লুগাহ জামাত পড়েছি। এ বছর কুল্লিয়া রাবে পড়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু যে বিশাল কাজের দায়িত্ব নিয়েছি, এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দরসি পড়াশোনার সুযোগ পাব না। এ কারণে এ বছর আর এখানে ভর্তি হইনি।

দারুল মাআরিফের স্মৃতিগুলো আমার বুকপকেটে জোনাকি হয়ে সবসময় জ্বলজ্বল করে। মাহাদুল কুরআন ভবনের চারতলায় ছিল আমাদের ছাত্রাবাস আর ক্লাসরুম ছিল মুফতি ফয়জুল্লাহ ভবনের দুতলায়। দরসের বাইরের পুরো সময়টা ছাত্রাবাসে কাটাতাম। ছাদ সবসময় খোলা থাকত। প্রায় বিকেলে সেখানে বসে থাকতাম। মাঝেমধ্যে অনন্যা আবাসিক সিটিতে যেতাম। জায়গাটা ছিল কাশবনে ছাওয়া। হাঁটাহাঁটি করলে বেশ ভালো লাগত। আর পেয়েছিলাম একটা দারুণ সাহিত্য সঙ্গ। আমি, আবদুল্লাহ মারুফ, কাজী ওয়ালি উল্লাহ, যুবাইর বশির—ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, ছাদে বসে আমরা নিয়মিত সাহিত্যআড্ডা দিতাম।

মাদরাসায় পৌঁছে প্রথমে পরিচিত সহপাঠীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করলাম। এক বছরের প্রীতিডোরে আবদ্ধ ছিলাম আমরা, সুখ-দুঃখের স্মৃতিচারণ হলো। কারও দেখা পেলাম, কাউকে পেলাম না। রেদওয়ান সামী আর মাহদি ভাই এ বছর ভর্তি হয়নি। তাদের দেখা না পেয়ে একটু খারাপ লাগল। তবে আবদুস সামাদের সাথে দেখা হওয়ায় ভালো লাগল। কয়েকজন উসতাদের সাথেও সাক্ষাৎ করলাম। জামিয়ার আমিনুত তালিম (শিক্ষাসচিব) মাওলানা শহিদুল্লাহ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে খুবই ভালো লাগল। তিনি আমাদের আকিদা ও ইংরেজি পড়াতেন। হুজুরের দরসগুলোতে অন্যরকম আমেজ আর আমোদ থাকত।

একটু জিরিয়ে গেলাম জামিয়ার নায়েবে মুদির (উপপরিচালক) মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলিল সাহেবের কাছে। হুজুর আমাদের সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগে থেকে অবগত ছিলেন। আমরা এসে সরাসরি সাক্ষাতে আবারও বিষয়টি বললাম। হুজুর খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের হালপুরসি করলেন। উদার মেহমানদারিও করলেন। শাহ সাহেব হুজুরের ওপর একটি লেখা দিতে রাজি হলেন; সেইসাথে আশ্বাস দিলেন, যওক সাহেব হুজুরের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দেবেন।

আল্লামা সুলতান যওক নদভীর অমিয় সান্নিধ্য

বাদ জুমা সাক্ষাৎ করলাম জামিয়ার বানি (প্রতিষ্ঠাতা) ও মুদির (মহাপরিচালক) আল্লামা সুলতান যওক নদভী সাহেবের সাথে। বাংলাদেশে আরবি সাহিত্যের পথিকৃৎ তিনি, সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর প্রতিকৃতি। এক বছরের ছাত্রজীবনে হুজুরকে শুধু দূর থেকে দেখেছি, কোনোদিন কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি। আজ সেটি সম্ভব হলো। শারীরিক দিক দিয়ে হুজুর এখন মাজুর, হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেন। শুক্রবার ছাড়া মসজিদে আসতে পারেন না। কথা বলতে কষ্টকর হওয়ায় লোকজনকে সাক্ষাৎকারও দেন না তেমন। আমাদের পরম সৌভাগ্য, হুজুরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম।

জুমার নামাজ পড়ে হুজুর দফতরে বসেছিলেন, সাথে মাওলানা ফুরকানুল্লাহ খলিল সাহেব। তখনই আমরা হাজির হলাম। হুজুরের খাদেম আবদুল হালিম ভাই জানালেন, আমরা জামিয়া ইমদাদিয়া থেকে এসেছি, আনোয়ার শাহ সাহেবের স্মারকের কাজে। জামিয়া ইমদাদিয়ার কথা শুনতেই হুজুরকে খুব প্রাণবন্ত দেখাল। তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে আমাদের বলতে লাগলেন তার জামিয়া ইমদাদিয়ায় শিক্ষকতা-জীবনের স্মৃতি, মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর কথা আর আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.-এর ওপর একটি চমৎকার মূল্যায়ন দিলেন; শেষে তার আত্মজীবনী ‘আমার জীবনকথা’ বইটি থেকে আরও কিছু তথ্য নিয়ে একটি লেখা তৈরি করতে বললেন।

হুজুরের এই সাক্ষাৎকার আমাদের বিপুল বিমুগ্ধ করল। তার মতো একজন মহিরুহ মনীষীর সান্নিধ্যের সৌরভে দারুণ বিমোহিত হলাম। কথাবার্তা শেষে হুজুর জামিয়ার উসতাদদের প্রতি সালাম পেশ করলেন। তখন তার সামনে নাস্তা এলো। রেকাবিভরতি তাজা ফল—আঙুর ও ডালিম। সেখান থেকে নিজের হাতে আমাদের ফল উপহার দিলেন। তার বরকতি হাতের মুসাফাহায় ধন্য করলেন আমাদের।

স্মৃতির আরেক প্রস্থ

রাতের বেলায় এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। ইশার সময় গেলাম মুফতি মাসুম সাহেবের কাছে। তার পিতা মাওলানা এহসানুল হক সন্দীপী রহ. জামিয়া ইমদাদিয়ায় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। ছিলেন জামিয়ার স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদিস। জন্মসূত্রে তিনি চট্টগ্রামের লোক হলেও বরিত ছিলেন ময়মনসিংহের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে। তার সাথে শাহ সাহেব হুজুরের ইসলাহি (আধ্যাত্মিক) সম্পর্ক ছিল। এ সূত্র ধরে মাসুম সাহেব আমাদের দীর্ঘক্ষণ সাক্ষাৎকার দিলেন। সাথে ছিল ইয়াসিন আর আবদুল্লাহ মারুফ। হুজুরের আন্তরিক ব্যবহার আর উদার মেহমানদারি আমাদের খুবই মুগ্ধ করল।

বাদ ইশা খাইরুল ভাইকে নিয়ে বের হলাম মাদরাসা-পরিদর্শনে। ঘুরে ঘুরে দেখলাম সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী ছাত্র পাঠাগার, আল্লামা ইউসুফ কারজাবি হলরুম এবং জামিয়ার মাকতাবা। এখানে পড়ার সময় এই তিনটি জায়গায় আমার দারুণ সময় কেটেছে। আসরের পরে যেতাম ছাত্র পাঠাগারে, সাহিত্যের বইপত্র পড়তাম। দরসের বিরতিতে আর মাগরিবের পরে যেতাম মাকতাবায়, আরবি বই-পত্রিকা পড়ে ঋদ্ধ হতাম। সব ঘুরে দেখে ক্যান্টিনে বসে বেশ জমিয়ে একটা আড্ডা দিলাম।

জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া : ইলমের বিমোহিত কাননে

আমাদের এবারের গন্তব্য আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া। দারুল মাআরিফ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম পটিয়ার উদ্দেশে। এখানে দুজন মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানালেই নয়। একজন দারুল মাআরিফের শিক্ষক মাওলানা মাহমুদ মুজিব—যার সহায়তায় আমাদের পটিয়ার কাজ অনেকটা সহজ হয়েছে। আরেকজন এহসান সিরাজ ভাই—যার আন্তরিক সহায়তা ও পথনির্দেশনায় আমাদের পুরো সফরটা খুবই সহজভাবে সমাপ্ত হয়েছে।

দুপুরের একটু আগে পটিয়া মাদরাসায় এসে পৌঁছলাম। পাড়ি দিয়ে এলাম কর্ণফুলি নদী আর বিস্তৃত ছায়াচ্ছন্ন পথ। এই প্রথম কর্ণফুলি নদী পার হলাম এবং পটিয়া মাদরাসায়ও এলাম প্রথমবার। গত বছর সুযোগ থাকলেও কোথাও বের হইনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মার্কেট, আন্দরকিল্লা, জামাল খান রোডের বাতিঘর—এ জায়গাগুলোতে যাওয়া হয়েছে শুধু।

মাদরাসার দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ আমাদের দারুণ মুগ্ধ করল। বেশি আকৃষ্ট করল পুকুরটা। পুকুরের টলটলে পানিতে অজু করে পাড়ের রোয়াকে বসে কাজের পরিকল্পনা ঠিক করলাম। প্রথমেই যোগাযোগ করলাম নায়েবে মুদির (উপপরিচালক) মাওলানা ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সাহেবের সাথে। তিনি আমাদের দুপুর আড়াইটার দিকে সাক্ষাতের সময় দিলেন। ততক্ষণ মাদরাসার মেহমানখানায় অবস্থান করতে বললেন।

মসজিদ থেকে জোহর পড়ে দুপুরের খাবার খেলাম মেহমানখানায়। মিষ্টি কুমড়ার লাবড়া আর মসুর ডাল—পেটে খুব ক্ষুধা ছিল বলে বেশ তৃপ্তি করে খেলাম। দুপুর আড়াইটায় গেলাম মাদরাসার দফতরে ইহতিমামে, ওবায়দুল্লাহ হামযাহ সাহেবের সাক্ষাৎকারে। তিনি আমাদের যথেষ্ট সময় দিলেন। তার কাছ থেকে জানলাম মাদরাসার সার্বিক অবস্থার কথা। সেইসাথে মুদির (মহাপরিচালক) আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি সাহেবের সাথে সাক্ষাতের কথা বললাম। তিনি জানালেন, হুজুর খুব অসুস্থ। মাদরাসায় আসতে পারেন না, বাসায় অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় তার সাথে সাক্ষাৎ করা কঠিন হবে। তারপরও হুজুরের ছেলের নম্বর দিলেন যোগাযোগ করার জন্য। শেষে আমাদের আরবি-উর্দু দুটো মাদরাসা-পরিচিতি এবং মাসিক আত-তাওহীদ ও বালাগুশ শারক-এর চলতি সংখ্যা দুটো হাদিয়া দিলেন।

বর্ষিয়ান আলেম মুফতি আহমদুল্লাহর সান্নিধ্য

তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ও বর্ষিয়ান আলেম মুফতি আহমদুল্লাহ সাহেবের কাছে। পটিয়া মাদরাসার প্রধান মুফতি ও শায়খুল হাদিস তিনি, বহু বই-কিতাবের রচয়িতা। তার উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ হলো—দুই খণ্ডে রচিত ‘মাশায়েখে চাটগামী’। বার্ধক্যের কারণে তাকে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করতে হয়। হুজুর দরস শেষ করে রুমে এলেন। আমরা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম এখানকার ছাত্র আমজাদ ইউনুসের সাথে। অচেনা জায়গায় পরিচিত-মুখের দেখা পেয়ে বেশ প্রসন্ন লাগছিল। কিন্তু হুজুরের সাক্ষাৎকারের জন্য আমজাদের থেকে বিদায় নিতে হলো।

মুফতি সাহেব শুয়ে ছিলেন। আমরা গিয়ে সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় এবং সফরের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। ভেবেছিলাম, তিনি তো বেশ মুরব্বি; হয়তো অনুচ্চ আওয়াজে কথাবার্তা বলবেন। কিন্তু আমাদের চমকে দিয়ে হুজুর বেশ টনটনে গলায় বললেন, ‘মিয়ারা, তোমরা কি মাওলানা আতহার আলী সাবের ওপর স্মারক করছ? আগে তারে নিয়া করো। তিনি তো ছিলেন বাংলার সম্পদ!’ জানালাম, ‘জি হুজুর, আনোয়ার শাহ সাবের তত্ত্বাবধানে তার ওপর একটি স্মারক হইছে। আর ‘হায়াতে আতহার’ নামে উর্দু ও বাংলায় একটি জীবনীগ্রন্থও বের হয়েছে। জামিয়া ইমদাদিয়ার শায়খুল হাদিস মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী সাব এ কাজটা আঞ্জাম দিছেন।’

মুফতি সাহেব তখন আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর সূত্র ধরে শাহ সাহেব হুজুরের ওপর একটি মূল্যায়নধর্মী বয়ান দিলেন। আমাদের চা-নাস্তার আপ্যায়ন করলেন। ততক্ষণে আসরের ওয়াক্ত হয়ে গেল।

স্মৃতির আরেক প্রহর

বাদ আসর গেলাম মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া সাহেবের কাছে। আমাদের যাওয়ার সাথে সাথে হুজুরের কিছু মেহমান চলে এলো। তিনি আমাদের সময় দিলেন সন্ধ্যা সাতটায়। এই ফাঁকে মাদরাসা-পরিদর্শনে বের হলাম। প্রথমেই গেলাম জামিয়ার মাকতাবায়। আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রহ.-এর সময়কালে এর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এত সুন্দর আর আলিশান মাকতাবা খুব কমই দেখেছি। বিশেষত এখানকার পত্রিকা-সংগ্রহের ব্যাপারটি আমাদের দারুণ অভিভূত করল। অনেক পুরাতন পত্রিকা আর জাতীয় দৈনিকের ভলিয়ম, সেইসাথে দুর্লভ গ্রন্থাদির সঞ্চয়ন—এগুলো দেখতে দেখতে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো।

বাদ মাগরিব আবারও বের হলাম মাদরাসা-পরিদর্শনে। শিক্ষাভবনটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দাওরায়ে হাদিসে দরস দিচ্ছেন মুফতি শামসুদ্দীন জিয়া সাহেব। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার আলোচনা শুনলাম। অন্যান্য জামাতে ছাত্ররা তাকরার (দলবেঁধে পড়াশোনা) করছে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। দেখলাম অনেকেই মোমের আলোয় পড়াশোনা করছে। ঘুরে ঘুরে আমরা গিয়ে ভবনের ছাদে উঠলাম। বিশাল ছাদ। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় চারদিকে শুধু ঘনায়মান আঁধার চোখে পড়ছে। বিকেলে এলে হয়তো শহরটা দেখা যেত।

এখানে অনেকটা সময় কাটিয়ে গেলাম মুফতি সাহেবের কাছে। হুজুর আমাদের সুন্দর ও গোছালো একটি সাক্ষাৎকার দিলেন। কথা বলার পুরোটা সময় তিনি মুখে ধরে রেখেছিলেন এক টুকরো মুচকি হাসি। তার কথাবার্তা আমাদের মুগ্ধ করল। বুখারি সাহেবের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হলো না। এজন্য দুজনের মনে মনে একটা আফসোস রয়ে গেল। তবে হুজুরের ছেলের সাথে আলাপ করে একটি পথ তৈরি করে এলাম। তিনি আমাদের লেখা নিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন।

শতবর্ষী জিরি মাদরাসায় এক রাত

পটিয়া মাদরাসায় রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু কাজের খাতিরে এখান থেকে রওনা হতে হলো। মাদরাসার মার্কেটে গিয়ে হালকা নাস্তা করলাম। তখনই ফোন দিলাম এহসান ভাইকে। তিনি পরামর্শ দিলেন, জিরি মাদরাসায় চলে যেতে। আমাদের ব্যাপারে কথা বলেছেন। রাতে সেখানে থাকব। সম্ভব হলে রাতে, নয়তো সকাল সকাল কাজ শেষ করে চলে যাব অন্য গন্তব্যে।

জিরি মাদরাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি রাত হয়ে গেল। মাদরাসায় ঢুকে আমরা সরাসরি চলে গেলাম দফতরে ইহতিমামে। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন মাওলানা খুবাইব সাহেব। মাদরাসার বর্তমান মহাপরিচালক তিনি। এর আগে মহাপরিচালক ছিলেন তার পিতা আল্লামা শাহ তৈয়ব সাহেব। কয়েক মাস আগেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন! গত বছর দারুল মাআরিফের ৩৫ বছর পূর্তি মাহফিলে হুজুরকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এত নুরানি চেহারা, দেখেই খুব ভালো লেগেছিল!

মাওলানা খুবাইব সাহেব অত্যন্ত সজ্জন লোক। আমাদের পরিচয় পেয়ে খুব আন্তরিকতা দেখালেন। যাওয়ার সাথে সাথে খাদেমকে বললেন রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করতে। এই ফাঁকে আমাদের সাথে আলাপচারিতা শুরু করলেন। কথায় কথায় জানালেন তার পিতার সাথে শাহ সাহেব হুজুরের সম্পর্ক ও স্মৃতির কথা। তার পিতা শাহ তৈয়বকেও তারা শাহ সাহেব হুজুর বলে ডাকেন। এর মধ্যে রাতের খাবারের ডাক এলো। রুই মাছের মুড়িঘণ্ট, সবজি, ডাল। তার আপ্যায়ন আমাদের বেশ পুলকিত করল।

রাত্রিযাপন করলাম মাদরাসার মেহমানখানায়। বাদ ফজর গেলাম শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ মুসা সাহেবের কাছে। কিন্তু শাহ হুজুরের সাথে তার পরিচয় না থাকায় বিশেষ কিছু নিতে পারলাম না। বেলা নটার দিকে খুবাইব সাহেব শাহ সাহেব হুজুরের ওপর একটি মূল্যায়নধর্মী লেখা দিলেন। বিদায়ের আগে গিয়ে জিয়ারত করে এলাম আল্লামা শাহ তৈয়ব রহ.-এর মাকবারা, সেইসাথে পরিদর্শন করে নিলাম মাদরাসাটা। মেহমানখানার নিচে অধ্যাপক মাওলানা আ ফ ম খালেদ সাহেবের রুম। তিনি এখানকার মুহাদ্দিস। সপ্তাহে তিনদিন আসেন দরস দিতে। তার সাথে আগেই যোগাযোগ হয়েছে। তিনি আমাদের মেইলে লেখা পাঠিয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

লালখান বাজার মাদরাসা : আলোকিত জ্ঞানোদ্যানে

আমাদের এবারের গন্তব্য লালাখান বাজার মাদরাসা। কর্ণফুলি নদী পেরিয়ে নিউমার্কেট হয়ে হাজির হলাম এখানে। মাদরাসার পরিবেশ চোখ জুড়িয়ে দিল। পাহাড়ি টিলার ওপরে পুরো ক্যাম্পাস আর জামে মসজিদ। চারদিকে সুবজ গাছগাছালি, ছায়াময় আবহ। মনোরম আবহাওয়া পেয়ে মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল ভ্রমণের অবসাদ। আসার সাথে সাথে মাদরাসা-পরিদর্শন করে নিলাম।

প্রথমেই গেলাম মুফতি হারুন ইজহার সাহেবের কাছে। পাহাড়ের নিচ থেকে উঠে এসেছে একটি ভবন। এখানেই তার বাসা আর মাদরাসার উচ্চতর বিভাগসমূহ। আমরা তার বৈঠকখানায় গেলাম। শুনলাম, তিনি রাতে ঢাকা থেকে সফর করে ফিরেছেন, এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। দুপুর পর্যন্ত এখানে বসে রইলাম। খাওয়ার সময় ইফতা বিভাগের ছাত্ররা আমন্ত্রণ জানাল। তাদের সাথে শরিক হলাম।

বাদ জোহর সাক্ষাৎ করলাম মুফতি ইজহার সাহেবের সাথে। এই মাদরাসার মহাপরিচালক তিনি, প্রবীণ রাজনীতিক আলেম। আল্লামা আতহার আলী রহ. প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির বর্তমান নির্বাহী সভাপতি। জামিয়া ইমদাদিয়ার পরিচয় পেয়ে তিনি আমাদের প্রতি খুবই আন্তরিকতা দেখালেন। আতহার আলী রহ. ও শাহ সাহেব হুজুরের ওপর চমৎকার স্মৃতিচারণ করলেন। বললেন, এগুলো তিনি লিখে দেবেন। আমাদের খাবারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। জানালাম, ইফতা বিভাগের ছাত্রদের সাথে খেয়েছি। হুজুর একটু আফসোস করলেন, আরও আগে কেন তার সাথে দেখা করলাম না।

কথাবার্তা শেষে আমাদের পাঠালেন তার জামাতা মাওলানা জামাল উদ্দীন সাহেবের কাছে। তিনি আমাদের কিশোরগঞ্জের লোক, নিকলী থানায় বাড়ি। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতে বেশ খুশি প্রকাশ করলেন। পাশেই এক মহিলা মাদরাসার দায়িত্বে আছেন তিনি। আমাদের তার বাসায় নিয়ে গেলেন। পাহাড়ি আনারসের জোস দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। তার আন্তরিক ব্যবহার দারুণ মুগ্ধ করল।

আসরের আগে আগে সাক্ষাৎ করলাম মুফতি হারুন ইজহার সাহেবের সাথে। তিনি দারুল ইফতায় দরস দিচ্ছিলেন। আমরা গিয়ে সেখানে বসলাম। আমাদের পরিচয় পেয়ে বেশ আন্তরিকতা দেখালেন। একটি লেখা দেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। যোগাযোগের জন্য নোট করে রাখলেন আমাদের নামঠিকানা। আসরের নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় তার সাথে মসজিদে চললাম। তখন তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বললেন—‘আমাদের দেশে আলেম-উলামার মূল্যায়ন জীবিত অবস্থায় হয় না। এর কারণ তাদের অবদানগুলো জাতির সামনে তুলে ধরা হয় মৃত্যুর পর, জীবিত অবস্থায় সেগুলোর প্রতি কারও নজর পড়ে না; অথচ বহির্বিশ্বের আলেম-উলামার মূল্যায়ন তাদের জীবিত অবস্থায়ই বেশ আয়োজন করে করা হয়।’

তার কথায় মাথা নাড়লাম। ঠিক কথাটিই বলেছেন তিনি। আমাদের মহিরুহরা মরে গেলেই আমরা কেবল পাণ্ডুলিপির আয়োজন করি। আসরের পর আবারও গেলাম তার বৈঠকখানায়। চা-নাস্তার আপ্যায়ন করলেন। সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎ শেষে বিদায় নিলাম।

উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসা : ইলমের প্রোজ্জ্বল বাতিঘর

আমাদের এবারের গন্তব্য উম্মুল মাদারিস হাটহাজারী মাদরাসা। মাত্র এক মাস আগেই ইন্তেকাল করেছেন এর প্রাণপুরুষ আল্লামা শাহ আহমদ শফি সাহেব। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন! বাংলাদেশী আলেম সমাজের গৌরব, মাদারিসে কওমিয়ার মহিরুহ মুরব্বি, হেফাজতে ইসলামের মহাজাগরণের অগ্রদূত এবং শাপলা-চেতনার উৎসধারা তিনি। এই মনীষীকে খুব কাছে থেকে একবারই দেখেছি—দারুল মাআরিফের ৩৫ বছর পূর্তি মাহফিলে। হুজুর সেদিন কাদিয়ানিদের বিষয়ে বয়ান করেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম এই শতবর্ষী আলেমের জ্বালাময়ী বয়ান। আমাদের পরম সৌভাগ্য, হুজুরের জীবদ্দশায় তার কাছ থেকে শাহ সাহেব হুজুর সম্পর্কে একটি মূল্যায়নধর্মী লেখা নিতে পেরেছি।

তার ইন্তেকালের পর মাদরাসার মজলিসে শুরা (পরামর্শ পর্ষদ) তিনজনকে মহাপরিচালকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করেন। তাদের প্রধান হলেন মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী সাহেব। বাংলাদেশের মুফতিয়ে আজম তিনি। হুজুরও বেশ আগে শাহ সাহেব হুজুরের ওপর স্মৃতি ও মূল্যায়নধর্মী একটি লেখা দিয়েছেন। মুফতি সাহেব মনে হয় উর্দু ভাষায় লেখালেখি করেন। আমাদের লেখাটিও উর্দুতে লিখে দিয়েছেন। সেটির অনুবাদ করে নিয়েছি। এখন বাকি আছেন আরও কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেব আমাদের মূল লক্ষ্য।

মাদরাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে মাগরিবের জামাত শেষ হয়ে গেল। মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়ে নিলাম। দেখা হলো একঝাঁক চেনামুখের সাথে। ইমরান, মুস্তাকিম, নাজমুল, আমিন—সবাই এখানকার দাওরায়ে হাদিসের ছাত্র। আমাদের অবস্থানের সব ব্যবস্থা ওরা করে রেখেছে। রাতের খাবার ওদের সাথে খেলাম। দেখলাম, ছাত্রদের প্রায় সবার ব্যক্তিগত রান্নার সুব্যবস্থা রয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার পর হালকা খোশগল্প করলাম। রাতে থাকার ব্যবস্থা হলো মেহমানখানায়। যেখানে যেতে যেতে মাদরাসা-পরিদর্শন করে নিলাম। এটা একটা দুঃখজনক সত্য—হাটহাজারী মাদরাসায় এবারই আমার প্রথম আসা!

মেহমানখানার ব্যবস্থা বেশ উন্নত। মাদরাসার মেহমানরা ছাড়া ছাত্রদের মেহমানরাও সেখানে থাকতে পারেন। ওরাও আমাদের সাথে এলো। ওদের কাছে জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে পরামর্শ করলাম। ওরা হুজুরের খাদেমের সাথে আলাপ করে এসে জানাল, আগামীকাল বেলা এগারোটায় বাবুনগরী সাহেব আমাদের সাক্ষাৎকার দেবেন। খুশি মনে ঘুমাতে গেলাম।

ঐতিহ্যবাহী মেখল মাদরাসায় এক সকাল

পরদিন খুব সকাল সকাল চলে এলাম মেখল মাদরাসায়। ঐহিত্যের আধার এই মেখল মাদরাসা। এখানেও আমার প্রথম আসা। বাংলার মুফতিয়ে আজম মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ. এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে এর মহাপরিচালক হিসেবে আছেন তার দৌহিত্র মাওলানা নোমান ফয়জি সাহেব। আমরা এসেছি তার সাক্ষাৎকারে। এসে জানলাম, হুজুর মাদরাসায় আসবেন সকাল দশটায়। আমরা বেশ আগেভাগে চলে এসেছি, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

সকাল সকাল বের হওয়ার কারণে নাস্তা করা হয়নি। মাদরাসার পাশে কতগুলো দোকানপাট দেখলাম। একটি হোটেল ঢুকে সেরে নিলাম নাস্তা। মাদরাসার পেছনে পুকুর, সাথে কবরস্থান। সেখানে গিয়ে কবর জিয়ারত করলাম। তারপর এসে মাদরাসা-পরিদর্শন করতে লাগলাম। এখানকার ঐতিহ্য হলো, ছাত্ররা নিজেরা রান্না করে খায়। সকালের খাবারের সময় হওয়ায় ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম এ অনন্য ঐতিহ্য। ছাত্ররা স্টোভে রান্না বসিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরেছে কিতাব।

বেলা দশটায় মাদরাসায় এলেন মাওলানা নোমান ফয়জি সাহেব। আমরা মেহমানখানায় হুজুরের অপেক্ষায় ছিলাম। তিনি এসে আমাদের দফতরে ইহতিমামে ডাকলেন। সফরের উদ্দেশ্য শুনে শাহ সাহেব হুজুরের ওপর একটি মূল্যায়নধর্মী বয়ান দিলেন। আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর সঙ্গে মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.-এর যে সম্পর্ক ছিল, এ নিয়ে সুন্দর কথাবার্তা বললেন। মাদরাসার দরসের সময় হয়ে আসায় হুজুরের তাড়া ছিল, তবুও আমাদের মেহমানদারি করতে চাইলেন। আমরা সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করলাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম হাটহাজারীর উদ্দেশে।

সিংহহৃদয় আলেম জুনায়েদ বাবুনগরীর সান্নিধ্য

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তখন হাদিসের দরস দিচ্ছিলেন। আমরা গিয়ে হাজির হলাম দরসগাহের সামনে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! হুইল চেয়ারের মসনদে সিপাহসালারের মতো বসে আছেন আল্লামা বাবুনগরী, তার সামনে একদল জানবাজ তালিবুল ইলম সৈনিক। তিনি হাদিসের তাকরির (ব্যাখ্যা ও পাঠ সমর্থন) দিচ্ছেন উদ্দীপ্ত কণ্ঠে। শত শত ছাত্র উন্মুখ হয়ে শুনছে তার তাকরির। হুজুরের মুখ নিঃসৃত কথামালা থেকে আহরণ করছে মূল্যবান মণিমুক্তা, জীবন পথের পাথেয়।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমরাও শরিক হলাম এই মহিমান্বিত দরসে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমরা যেন আহমদ ইবনে হাম্বল এবং আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের হাদিসের দরসে বসে আছি। মসনদে বসে যিনি তাকরির দিচ্ছেন—আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী—তিনিই এ যুগের আহমদ ইবনে হাম্বল এবং আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক। কারণ আমি তখন তার মাঝে এই দুই ইমামের ছায়া দেখছিলাম। কেননা তিনি ছিলেন ইবনে হাম্বলের মতো সিংহহৃদয় আলেম; যাকে জেলজুলুমও তার নীতি থেকে টলাতে পারেনি। এবং ছিলেন ইবনে মুবারকের মতো ইলমের আধার; যার মনীষার দীপ্তিতে প্রোজ্জ্বল ছিল চারপাশ।

দরস শেষে হুজুর মাদরাসার মাঠে গেলেন রোদ পোহানোর জন্য। তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল একদল ছাত্র। ভাবলাম, সেখানে গিয়েই হুজুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই তার হুইল চেয়ারের চাকা রুমের দিকে চলতে আরম্ভ করল। ইমরান হুজুরের সাথে সাথে আসছিল। মুস্তাকিম, নাজমুল, আমিন ছিল আমাদের সাথে। হুজুরের পেছনে আমরাও রুমে ঢুকলাম। ওরা গিয়ে আবারও হুজুরের খাদেম এনামুল হাসানকে আমাদের কথা বলল। সাড়া পেয়ে আমার রুমের ভেতরে ঢুকলাম।

হুজুরের চারপাশে তখন ছাত্র ও সাধারণ মানুষের একটা জটলা। নানাজন নানা কারণ ও সমস্যা নিয়ে তার সাথে কথা বলছে, তিনি তাদের জবাব ও সমাধান দিচ্ছেন। আমরা দাঁড়িয়ে সুযোগ খুঁজছি। হুজুর তখন একটা কারণে খুবই পেরেশান। সরকারিভাবে তার মাহফিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হুজুরের পেরেশানি দেখে আমরাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম—কী জানি সাক্ষাৎকার নিতে পারব কি না! কিন্তু আল্লাহর রহমতে সব আসান হয়ে এলো।

ভিড় একটু কম দেখে সাহস করে বসে পড়লাম হুজুরের সামনে। তার কাছে ব্যক্ত করলাম আমাদের সফরের উদ্দেশ্য। পেরেশানির কারণে হুজুর প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করলেন। বললেন, আমরা যেন একটা লেকা তৈরি করে নিই। কিন্তু আমরা আবারও সবিনয়ে আরজ করলাম। বেশ কিছু প্রশ্নও করে বসলাম। হুজুর বেশ কয়েকটা প্রশ্নের হালকা উত্তর দিয়ে একসময় আল্লামা আতহার আলী রহ. সম্পর্কিত একটি প্রশ্নে কথাবার্তা শুরু করলেন।

তিনি এবং শাহ সাহেব হুজুর দুজনেই আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরি রহ.-এর ছাত্র। এ সূত্র ধরে চমৎকার মূল্যায়ন ও স্মৃতিচারণ করলেন। সেইসাথে আমাদের একটি দরকারি তথ্য দিলেন—আল্লামা আতহার আলী রহ.-এর ইন্তেকালের পর আল্লামা বিন্নুরি রহ. তার ওপর মাসিক ‘বায়্যিনাতে’ একটি সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। সুযোগ পেয়ে হুজুরকে কিছু আত্মজৈবনিক প্রশ্ন করে বসলাম। হুজুর সেগুলোরও সুন্দর উত্তর দিলেন। শেষে কথাগুলোকে সাজিয়ে-গুছিয়ে লেখা তৈরির কথা বললেন। সেইসাথে আমাদের ফল দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। এই সিংহহৃদয় আলেমের সান্নিধ্য আমাদের দারুণ ঋদ্ধ করল।

স্মৃতির আরেক ঝলক

বাবুনগরী সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ করে গেলাম মুফতি কিফায়াতুল্লাহ সাহেবের কাছে। মাওলানা এহসানুল হক সন্দীপী রহ.-এর বড় ছেলে তিনি, ছিলেন শাহ সাহেব হুজুরের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। হুজুরের অনেক স্নেহ-শফকত পেয়েছেন। এ সূত্র ধরে তিনি শাহ সাহেব সম্পর্কে চমৎকার স্মৃতিচারণ করলেন। তার কথাবার্তার পুরোটা জুড়ে ছিল হুজুরের ইলমি মনীষার বয়ান ও মূল্যায়ন।

মুফতি সাহেব কথাপ্রসঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার মান নিয়ে বললেন, ‘কোনো বিষয়ে বিপ্লব ঘটাতে হলে আগে শিক্ষাকে মানোন্নয়ন করতে হবে। প্রথমে শিক্ষার মানোন্নয়ন, তারপর বিপ্লব। একটা জাতির শিক্ষাব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে তারা সমাজে নেতৃত্ব দিবে কীভাবে? তাই সবার আগে শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত ও মানসম্পন্ন করতে হবে।’ তার এই কথাটি থেকে ভাবনার খোরাক পেলাম। মুফতি সাহেবের আন্তরিকতা ও আপ্যায়ন আমাদের দারুণ মুগ্ধ করল।

মন্তব্য করুন
শেয়ার করুন
Amar Kotha

আমি মুজিব হাসান। আমার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড় এলাকার এক কৃষক পরিবারে। দিনটি ছিল ১৩ বোশেখ—নতুন ফসল ঘরে তোলার আমেজময় সময়। বাপদাদার পেশা হাওড়ের চাষাবাদ আর গাঙের জলমহাল। আমার ইচ্ছা লেখালেখিকে নিজের পেশা হিসেবে বরণ করে নেব। এ দেশে কলমকারি করে জীবিকা নির্বাহ করা যদিও বেশ কঠিন কাজ, তবুও এ ইচ্ছা জিইয়ে রাখব।

পড়াশোনার পুরোটা কওমি মাদরাসায়। জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ থেকে দাওরায়ে হাদিস, এরপর জামেয়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামে আরবি সাহিত্য পড়েছি। করোনা মহামারির সময়টায় শুরু করেছি কর্মজীবন। প্রকাশনায় কাজের ইচ্ছা থেকে বর্তমানে সম্পাদনার কাজবাজ করছি। এছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো এখনো কোনো পাটাতন তৈরি করতে পারিনি।

হাওড়ের জীবন, প্রকৃতি ও মানুষ দেখে জেগেছে আমার লেখালেখির বোধ। জীবনের প্রথম রচনা একটি খুদেগল্প—লিখেছিলাম মক্তব সুওমে পড়ার সময়। মক্তব পাঞ্জম থেকে শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ডায়েরি আর ছড়া-কবিতা ছিল আমার নিত্য কলমকারি। হেদায়াতুন্নাহু জামাতে পড়ার সময় গল্প-উপন্যাস রচনায় হাত দিই। এক খাতায় এক বসাতে লিখতাম আস্ত উপন্যাস!

স্কুল-মাদরাসার পাঠ্যবইগুলো আমার সাহিত্য পাঠের প্রথম জোগান। শহুরে পরিবেশে এসে বই পড়ার দিগন্ত আরও প্রসারিত হলো। মাদরাসার সাহিত্য পাঠাগার, পাবলিক লাইব্রেরি, বইয়ের দোকানে ছিল নিত্য যাতায়াত। গল্প-উপন্যাস পড়তে বেশি ভালো লাগে। কবিতা আমার অবসরের সঙ্গী। কুরআনের তাফসির ও জীবনী সাহিত্য বেশ টানে। খুব রয়েসয়ে পাঠ করি চিন্তামূলক রচনাগুলো।

পৃথিবীর বুকে আমি একটি নুক্তা কিংবা নুড়ি। বয়স ও সময়ের ঘর্ষণে ক্ষয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। চিহ্নপত্রে নিজেকে নিয়ে বলার মতো এটুকুই কথা। বাকি সব বকওয়াজ।

ফেসবুকে আমি

এটা আমার ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
অনুমতি ছাড়া এখান থেকে কোনো লেখা বা ছবি কপি করা অন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।

<
.

নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন

© ২০২৫ মুজিব হাসান