শীতের সকাল। আকাশের জাফরি গলে চুঁইয়ে পড়ছে দইয়ের ঘোলের মতো কুয়াশা। ঝিরঝিরে বাতাস বয়ে আনছে বরফকুচির আর্দ্রকণা। এক চাকতি কমলালেবুর মতো সূর্য ছড়াচ্ছে কুসুম রোদ। প্রকৃতির এরকম দৃশ্যপট দেখতে দেখতে আমরা রওনা হলাম আনসারনগরের উদ্দেশে। বাংলার সিরাত সাহিত্যের জনক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.-এর আনসারনগরে, তার পুণ্যস্মৃতির খোঁজে। মাওলানা খানকে আমি চিনেছি তার সাড়াজাগানো আত্মজীবনী ‘জীবনের…
পাঠ্যবইয়ের আমোদ
বই পড়া নিয়ে যখন স্মৃতি রোমন্থন করি, মনের গহিন থেকে উজ্জ্বল উদ্ধার হয়ে উঠে আসে ‘শিশুছন্দ’ বইটির কথা। আমাদের বাল্যশিক্ষার সময়ে এটি ছিল মাদরাসার শিশু শ্রেণির পাঠ্য। এই বই থেকে নিয়েছি ছন্দোময় নীতিকথায় বাংলা বর্ণপরিচয়ের আমোদিত পাঠ। পড়ার সময় নীতিকথার পঙক্তিগুলো মনে খুব দাগ কাটত, ছন্দের দোলা জাগিয়ে তোলত অপূর্ব মোহন। প্রতিটি বর্ণ ও বাক্যে…
যখন মাসের শেষ
মাসের বিশ তারিখের পর থেকে বিবর্ণ হয়ে আসে প্রতিটি দিন। একটু একটু করে বিষণ্ণ হতে থাকে মন। যাপনের আনন্দ পরিণত হয় ঝরাপালকের বিস্বাদে। নিঃশব্দে ফেলা নিশ্বাসটুকুও হয়ে যায় হাহাকারের হাওয়া। তখন কেবল চোখের সামনে দেখতে পাই একটি ঝুলন্ত শেকল—যার আংটাগুলোতে ঝুলতে থাকে কতগুলো চিরকুট : বাসাভাড়া, খাবার বিল, মিলের বাজার, টুকটাক কেনাকাটা, যাতায়াত খরচ, ঋণ…
আল্লামা আযহার আলী আনোয়ার শাহ
গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতির মালঞ্চ
গুচ্ছ গুচ্ছ স্মৃতির মালঞ্চ
প্রথম দেখার দিন আমি যে পরিবারে জন্মেছি এবং যে পরিবেশের আলোবাতাস গায়ে মেখে বেড়ে উঠেছি, এখানকার কারও মুখে ‘শাহ সাহেব হুজুর’, ‘আনোয়ার শাহ হুজুর’ বা ‘মাওলানা আনোয়ার শাহ’—এ নামটি কিংবা সম্বোধনটি তাকে নিজে চেনার আগ পর্যন্ত শুনেছি বলে মনে পড়ে না। হাওর এলাকার এক চাষাভুষা পরিবারে এবং গৃহস্থালি পরিবেশে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল…
মাওলানা আতহার আলী রহ.-এর সাহিত্য-মনন
তিনটি দেয়াল-কবিতা
তিনটি দেয়াল-কবিতা
মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতহার আলী রহ. ছিলেন একজন মননশীল হৃদয়ের অধিকারী এবং অসাধারণ সাহিত্যপ্রেমী ব্যক্তিত্ব। ইসলামি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি তিনি নিজের ভেতরেও লালন করতেন এক অনন্য সাহিত্য-মনন। সেই মননশীলতার ছাপ আজও প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে তার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ জামিয়া ইমদাদিয়ার দেয়ালে। ১৯৫২ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলনের জোয়ার উঠেছিল, সেসময় মাওলানা…
মিছরির ছুরি
মানুষের জিহ্বা এক মারাত্মক অস্ত্র। এর আঘাত যেকোনো ধাতব অস্ত্রের চেয়ে সাংঘাতিক। এটা শরীরে লাগে না, কিন্তু হৃদয়কে এমনভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়, যা কাউকে দেখানো যায় না। প্রবাদে যেমন বলা হয়— লাঠির আঘাতে রক্ত ঝরে, কথার আঘাতে প্রাণ নড়ে। কথাটি ধ্রুব সত্য। লাঠির আঘাত দিনদুয়েক কিংবা সময়ের ব্যবধানে সেরে ওঠে, কিন্তু কথার আঘাত হৃদয়ে এমন…
যে স্মৃতি জল-বাতাসার
মাদরাসাজীবন। জীবনের খেলাঘরে সুখের বারান্দা। কারও চৌদ্দ বছর, কারও দেড় যুগ, কারও-বা আরও বেশি—আমরা বাস করি এই ঘরে, সংসার পাতি সুখের বারান্দায়। ফালি ফালি রোদ, টুকরো টুকরো ছায়া—মায়াময় এক সোনালি সংসার। মাথার ওপর ঝলমলে চাদোয়া। সেখানে জমা হয় যাপিত জীবনের নানারঙা স্মৃতি। সুখ-দুখের কানাকড়ি, হাসি-কান্নার হিরেপান্না, আনন্দ-বেদনার বর্ণিল গাথা। স্মৃতির ঝালর লাগানো রঙিন মখমলে দিন—যা…
ঘায়েল বান্ধার দিন
আমাদের হাওড় এলাকায় বর্ষাকাল শুরু হয় সময়ের একটু আগে; জষ্টি মাসের মাঝামাঝিতে। কোনো বছর বর্ষা আসে ঠিক সময়ে—আষাঢ় মাসে, আবার কোনো বছর এসে যায় অনেকটা আগেভাগে—বোশেখ মাসের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে। তা যেভাবেই আসুক, বর্ষার মরসুমটি কিন্তু হাওড় এলাকার জনজীবনে বিরাট প্রভাব ফেলে। শুকনা আর বর্ষা—হাওড়ের ঋতু হিসেবে এ দুটোকে ধরা হয়। শুকনা মরসুমে সমস্ত…
গুলিস্তানের পথমুখ
রামপুরা থেকে কদমতলি যাব। আকাশ পরিবহন বাসে উঠলাম। বাসটা বিজয়নগর মোড় পর্যন্ত মোটামুটি টেনে এলো। এখানে এসে পড়ল মহাজ্যামে। একটু একটু করে এগোয়, থেমে থাকে অনেকক্ষণ। পল্টন মোড়ের ট্রাফিক পার হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেল—যেখানে আমি বাসে উঠেছিলাম পৌনে ছয়টায়। জিপিও মোড়ে এসে পড়ল বিরাট জ্যামে। এবার ড্রাইভার ইঞ্জিনের স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইল।…
আফালের দিনে
রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের নিদাঘ দুপুর। হাওড়ের গেইটওয়ে চামটা বন্দরের ট্রলারঘাটে এসে দাঁড়ালাম। ঘাটলায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ল দিগন্ত বিসারিত ঢেউখেলানো হাওড়। টলটলে জলরাশি উত্তাল বাতাসের আশকারা পেয়ে নিদারুণ উচ্ছলিত হচ্ছে। উন্মীলিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে বিস্মিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। ঘাটলার প্রায় পুরোটা হাওড়ের পানিতে নিমজ্জিত। উপরিভাগের কয়েকটা সিঁড়ি আর খানিকটা পিচ রাস্তা ভাসমান। চামটাঘাটের এমন জলমগ্ন রূপ…